গ্রামের যাকেই কথা বলার জন্য ফোন দেই তাদের মুখ থেকে কথা আর আসে না, আসে শুধু কান্না আর কান্না। বাবা মা ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার কান্না আর হাহাকারে ভারী হয়ে উঠেছে হাওরের আকাশ বাতাস। এটা এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সর্গচ্যূত কোন দেবতাও যদি তা অবলোকন করতে আসে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না, ঢুকরে কেঁদে উঠবে ক্ষণে ক্ষণে।
কাদঁবেই বা না কেন? তাদের সারা বছরের হাড় খাটুনির সোনালী ফসল, সারা বছর দিন গুজরান করার একমাত্র অবলম্বন যে ভেসে যাচ্ছে অকাল বন্যায়। এক মাসের মধ্যেই সোনালী ফসলে ভরে যেত কৃষকের গোলা। কৃষকের মুখে মুখে থাকতো হাসি আর হাসি। যে ছেলেটি গোলায় নতুন ধান উঠার পর বাবা মার কাছ থেকে নতুন শার্ট উপহার পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। বিধাতার কাছে তার এখন দাবি একটাই তারা যেন সারা বছর তিন বেলায় পেট ভরে খাওয়ার মত পর্যাপ্ত ধান গোলায় তুলতে পারে। কিন্তু হায় নিষ্ঠুর প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা যে বড়ই নির্মম। সে কি দরিদ্র কৃষকদের সেই সুযোগটা দিবে?
দিন অতিবাহিত হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নদীর পানি। বড় বড় বাঁধ ভেঙ্গে গ্রাস করছে কৃষকের সোনালী ফসল। একের পর এক ডুবছে কৃষকের জমির অপরিপক্ব ফসল, বাড়ছে হাহাকার। অবস্থাটা এমন কবির ভাষায় “কাচা ধান কাটিলে হায় কী হইবে, না কাটিলে পানির নিচে তলিয়ে যাবে।” হাওরে ছয় মাস পানি থাকে আর ছয় মাস শুকনো থাকে। পানির মৌসুমে কৃষকেরা কর্মহীন দিন যাপন করে। আর শুকনো মৌসুমে দিন রাত পরিশ্রম করে তাদের একমাত্র ফসল ধান ফলায়। ফসল বলতে ধান ছাড়া অন্যকোন ফসল এখনকার পরিবেশে উপযোগী নয়। তারা আশার প্রহর গুনে কখন বৈশাখ আসবে আর কখন তারা তাদের সোনালী ফসল ধান ঘরে তুলবে। আশায় আশায় পৌষ যায়, মাঘ যায়, ফাল্গুন যায়। আসে বেদনার মাস চৈত্র মাস।
খুব সম্ভবত ইংরেজ কবি ওয়ার্ডস ওর্থ এপ্রিল মাসকে সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। কিন্তু আমাদের হাওরবাসীর জীবনে সে মাসটি নিঃসন্দেহ চৈত্র। বড়ই অভাবের মাস এটি। কৃষকদের ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও পকেটে পয়সা না থাকায় হাওরবাসীরা এই মাসে কোন রকম খেয়ে না খেয়ে নিদারুণ অভাবে কাটায়। তাদের ঘরে চাল না থাকায় তিন বেলা না খেয়ে একবেলা খায়, ভাত না খেয়ে মিষ্টি আলু, রুটি খায়। অনেকের কাছে এই কথাগুলো রূপকথার গল্পের মত লাগতে পারে। কিন্তু হাওরে এখনও এটাই বাস্তবতা। এখানকার মানুষ গুলো ছিটমহলবাসীদের চেয়েও বেশি মানবেতর জীবন যাপন করে। ছিটবাসীরা মানবেতর জীবন যাপন করলেও তারা ভাগ্যবান। কর্পোরেট মিডিয়া থেকে শুরু করে দেশের সব মিডিয়াই তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা জনগণ এবং সরকারকে অবহিত করে। কিন্তু এখানকার মানুষগুলো এমনই অভাগা যে কোন মিডিয়াই তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা ঠাঁই পায় না। ফলে ধুকে ধুকে শেষ হয় এখানকার মানুষের এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের জীবন। এখানের লোকেরাও সরকারকে ভোট দেয়, রাষ্ট্রকে কর দেয়। রাষ্টের প্রতি তারা তাদের যাবতীয় কর্তব্যই পালন করে। বিপরীতে তারা রাষ্ট্র কর্তৃক সামান্যতম অধিকারটুকু পায়। তারা বিদ্যুৎ, মসৃণ যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসক এ রকম আরও অনেক আধুনিক সুযোগ সুবিধা থেকে যোজন যোজন দূরে। সরকারের একটু খানি সুনজরই পারে এই অবহেলিত হাওর বাসীর ভাগ্যের চাকা ঘুরিতে দিতে। হাওরকে মূল্যবান সম্পদে পরিণত করতে ।
লেখক : অনুপম হোসাইন উজ্জ্বল
The post হাওরবাসীর শোকগাথাঁ appeared first on Bangladesh Study Forum.