বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়ে তার ব্যাপক ভালোবাসা ছিল। তিনি তাকে অনেক উচ্চে স্থান দেন। নীরদের কাছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘মহাপুরুষ বঙ্কিম’। পাশ্চাত্য জগতে ‘গ্রেট ম্যান’ বলতে যা বুঝায় তিনি তাই।
এ নিয়ে নীরদের মত হচ্ছে,
“বাঙালির ভারতব্যাপী প্রতিষ্ঠা প্রথম চৈতন্যদেবের দ্বারা হয়। উহার চেয়েও বড় প্রতিষ্ঠা ঊনবিংশ শতাব্দীতে যাঁহাদের দ্বারা হইয়াছিল সেই বাঙালিদের মধ্যে বঙ্কিমকে প্রধান বলা যাইতে পারে।” (নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৯৯)
শ্রেষ্ঠ বাঙালি কে?
১৯৮৮ সনের ৩ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় বঙ্কিমকে নিয়ে লিখতে গিয়ে নীরদ লিখেন:
“বাঙালির সমগ্র ইতিহাসে বাঙালি হিসাবে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ তিনি রবীন্দ্রনাথ, তাঁহার অপেক্ষা বড় বাঙালি জন্মে নাই, জন্মিবেও না।..তাঁহার পরেই বঙ্কিমচন্দ্র, কেশবচন্দ্র সেন, বিবেকানন্দ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও সুভাষচন্দ্র বসু। “
রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ‘বড় বাঙালি জন্মে নাই, জন্মিবেও না’- এ কথাটি বলে নীরদ ভবিষ্যতের প্রতি অন্যায় করেছেন! রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই জন্মাবেনা, কেউই পুনর্জন্ম লাভ করেনা বা তার দরকারই নেই কিন্তু তার মানের বা তার চেয়ে বড় কেউ জন্মাবেনা এটা একজন ভক্তের পত্রিকা কলাম হিসাবেই নিলাম, ঐতিহাসিক ও নাক উঁচা লেখক নীরদ থেকে নিলাম না।
৬ শ্রেষ্ঠ বাঙালি
চারটি ক্যাটাগরিতে ৬ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকা করেছেন নীরদ সি চৌধুরী।
১. রবীন্দ্রনাথ, মহাকবি, শ্রেষ্ঠ কবি। শুধু বাংলা ভাষায় নয় বিশ্বের যেকোন ভাষার শ্রেষ্ঠ কবির যোগ্যতা আছে রবীন্দ্রনাথের। তিনি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বকবি।
২. শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তারা বিশ্বমানের সেরা ঔপন্যাসিক।
৩. শক্তিমান ধর্মপ্রচারক: কেশবচন্দ্র সেন ও বিবেকানন্দ
৪. আত্মবলিদানকারি নেতা: সুভাষচন্দ্র বসু
তার এই ৬ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ঈশ্বরচন্দ্রের অনুপস্থিতি অনেকেরই সমালোচনার কারণ হয়েছিল। তিনি এর জবাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিয়ে অনেক লিখেছেনও। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিয়ে তার মনোভাব হচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্র মহাপুরুষ নি:সন্দেহে কিন্তু তিনি শ্রেষ্ঠ বাঙালি নন।
শ্রীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী
তাকে একটু বেশি গালি দিবেন বলেই হয়তো তার প্রবন্ধের শিরোনামটি এমন রেখেছিলেন। প্রমথ চৌধুরী নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন নীরদ চৌধুরী। ওখানে প্রমথের প্রশংসার চেয়ে সমালোচনার ভার অনেক বেশি। প্রমথভক্ত ও সুধীমহলে ওগুলো বেশ সমালোচনার কারণ হয়। শুধু একটু অংশ তুলে ধরি:
“…তবুও প্রমথবাবুর জীবন একটা ট্র্যাজেডি। প্রমথবাবু ‘পলিটিকস্, ইকনমিকস্, শিক্ষা, সমাজ, হিন্দুধর্ম্ম, ইসলামধর্ম্ম ইত্যাদি যেকোন একটা অথবা সবকটা নিয়ে অতি গম্ভীর ও অতি রাগতভাবে নানারূপ প্রভু-সম্মত বাণী ঘোষণা করিতে পারেন না, ইহাই তাঁহার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি নয়। তাঁহার জীবনের ট্র্যাজেডি ইহাই- যে এই বৈদগ্ধ্যবর্জিত বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করার ফলে অতি ক্ষুদ্র বিষয়ে তাঁহার অতি তুচ্ছ রসিকতাকেও লোক একটা গুরুগম্ভীর দার্শনিক তত্ত্ব বলিয়া ভুল করিয়া বসে।”
আত্মঘাতী বাঙালী ও আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রচর্চার বর্তমান হালহাকিকত বলতে গিয়ে নীরদ তার ভূমিকায় বলেন ,
“বর্তমানে অবশ্য অবস্থাটা উল্টা হইয়াছে, অর্থাৎ রবীন্দ্রনিন্দকেরা লোপ না পাইলেও রবীন্দ্রভক্তেরাই প্রবল হইয়াছে। কিন্তু না ভক্তি না নিন্দা, কোনটাই উচ্চস্তরে উঠে নাই। এখনও রবীন্দ্রনাথের সত্য রূপ আত্মপ্রকাশ করিতে পারিতেছে না।
আমি সারাজীবন সেই রূপটি ধরিবার চেষ্টা করিয়াছি, মনে হয় অবশেষে হয়ত ধরিতেও পারিয়াছি। তবে আমার ধারণায় তাঁহার যে রূপ আসিয়াছে উহা এক নয়, দ্বিধাবিভক্ত। উহার একদিক আত্মসমাহিত রবীন্দ্রনাথের, অন্যদিক আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথের। এই দুই রূপের অবিচ্ছিন্নতাই তাঁহার জীবনের বৈশিষ্ট্য।” (আত্মঘাতী বাঙালী ও আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, পৃষ্ঠা ৩, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স)
নীরদের এই আত্মবিশ্বাস ও দু:সাহসকে সাধুবাদ না জানানোর উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তার অনন্য মতামত ঈর্ষা, হিংসা বা বিদ্বেষপ্রসূত নয়। এটা রবীন্দ্রনাথকে explore করে আসল রূপটি ধরার ইংরেজ বা ইউরোপীয় সুলভ বৈশিষ্ট্য।
ক্ষুধিত পঙ্কে রবীন্দ্রনাথ
অনেক প্রতিভাধর বাঙালী জন্মেছেন কিন্তু একটা সীমা পর্যন্ত গিয়ে কেন আর আগাতে পারে না তার পোস্ট মর্টেম করার চেষ্টা করেছেন নীরদ। মহাভারতের কর্নের চাকা যেমন বালুতে আটকে যায় তেমনি যেন বাঙালির উর্ধ গমন একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বা একটা জায়গায় গিয়ে পঙ্কিল হয়ে যায়। এমনকি অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বও সেই ক্ষুধিত পঙ্ক থেকে বাঁচতে পারেনি। নীরদের জবানিতে:
“… যাঁহাদের প্রতিভা সম্বন্ধে সন্দেহ করা চলেনা-তাঁহারাও এই পঙ্কে ডুবিয়াছেন। কয়েকজনের উল্লেখ করিব-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্র বসু, পাণ্ডিত্যে হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী ও দেবপ্রসাদ ঘোষ, সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রেমেন্দ্র, শৈলজানন্দ ও হুমায়ুন কবীর। ইহাদের কেহই প্রভাতে উদিত হইয়া মধ্যাহ্নের আকাশ পর্যন্ত যান নাই। বুদ্ধদেব বসু সম্বন্ধেও তাহাই বলিব, তাহাকে শুধু বাঙালী জীবনের মানসিক ক্ষুধিত পঙ্কই গ্রাস করে নাই, যাদবপুরের বাধাও তাঁহাকে কবিপদ হইতে অধ্যাপকপদে নামাইয়াছিল। মরণং যাদবপুরে, অপরং বা কিং ভবিষ্যতি।
আরও অনেকের কথা বলিতে পারিতাম, তবে তালিকা বৃদ্ধি না করিয়া, যিনি আমার তালিকার শীর্ষে, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ, তাঁহার দশাই দেখিব। তাঁহার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভাবে ক্ষুধিত পঙ্ক গ্রাস করিতে নিশ্চয়ই পারে নাই; কিন্তু তাঁহার জীবনকে, গ্রাস করিতে না পারিলেও দু:খের বিষে জর্জরিত করিয়াছিল। উহার আকর্ষণ হইতে নিজেকে বাঁচাইবার জন্য তিনি যে সংগ্রাম করিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি যেন পাগল হইয়া গিয়াছিলেন। স্বজাতির আচরণ সম্বন্ধে তিনি যৌবন হতে বার্ধ্ক্য পর্যন্ত যেসব উক্তি করিয়াছিলেন তাহা যেন পাগল মেহের আলির ‘তফাৎ যাও, তফাঁ যাও’ চীৎকারের মত। শেষ পর্যন্ত ক্ষুধিত পঙ্ক তাঁহার জীবনকে ক্লান্তিতে অবসন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল, কিন্তু উহার অন্তর্নিহিত মহত্ত্ব ও সেই মহত্ত্বের সাহিত্যিক প্রকাশকে নষ্ট করিতে পারে নাই-তবু উহাকে জীবনব্যাপী দু:খের সহিত জড়িত করিয়া রাখিয়াছিল। সেজন্য এককালে আমি তাঁহার সাহিত্যসৃষ্টিকে ‘les fleurs du mal’ বলিতাম। এত মহান্ ও এত বহুমুখীন প্রতিভাবান ব্যক্তির এমন দু:খময় জীবনের কথা আমি কোনো দেশের সাহিত্যিক ইতিহাসে পড়ি নাই।”
(আত্মঘাতী বাঙালী ও আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী, পৃষ্ঠা:৫)
সাবিদিন ইব্রাহিম
sabidin@bdsfbd.com
The post কতিপয় বাঙালি নিয়ে নীরদ চৌধুরীর মূল্যায়ন appeared first on Bangladesh Study Forum.