This is a test post under all category.
Soon BD study forum will be live.
The post Random Test Post appeared first on Bangladesh Study Forum.
This is a test post under all category.
Soon BD study forum will be live.
The post Random Test Post appeared first on Bangladesh Study Forum.
বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। শুরু হলো বাংলাদেশ স্টাডি ফোরামের ‘বাংলাদেশ পাঠ সিরিজ’। পুরো ডিসেম্বরের সবগুলো সাপ্তাহিক লেকচার হবে বাংলাদেশকে নিয়ে; বাংলাদেশের ইতিহাস, মানুষ, মানুষের জীবন, জীবন-সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, ব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ে বই, বাংলাদেশের সমস্যা, সমাধান, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যত ইত্যকার বিষয় নিয়ে আলোচনা চলবে পুরো ডিসেম্বরেই।
আমাদের প্রথম লেকচার ‘হাওরবাসীর জীবনকথা’। আলোচক-এএসএম ইউনুছ। আগামী শনিবার বিকাল ৪.৩০টায়। স্থান ডাকসু-দ্বিতীয় তলা
এএসএম ইউনুছ সেসব জায়গাতেই গবেষণার আলো ফেলেছেন যেখানে খুব কম গবেষকই কাজ করেছেন। ছিটমহলবাসীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে একজন সফল নেতা। কাজ করেছেন পদ্মা নদীসহ বাংলাদেশের নদ-নদী নিয়ে। এটা সবার জানা কথা বাংলাদেশকে যদি আমরা কোন দেহের সাথে কল্পনা করি তাহলে এর নদীগুলো এর রক্তপ্রবাহ। রক্তপ্রবাহ ঠিকমত না হলে, বাঁধার মুখোমুখি হলে যেমন দেহ ঠিক থাকতে পারেনা তেমনি নদীর সঠিক প্রবাহ ছাড়া এই দেশের জীবন-প্রকৃতি, বা ভৌগলিক পরিবেশ ঠিক থাকতে পারে না।
দেশের নদীগুলোর পাড় বেয়ে বেয়ে হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল। কান পেতে শুনেছেন নদীর অতীতের কথা যা তার কঙ্কালসার ঢেউয়ে লেখা আছে। পত্র-পত্রিকায় লিখেছেন নিরন্তর। বইয়ে তুলে এনেছেন নদ-নদীর আহাজারি। উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে ‘পদ্মা নদীর জীবন ও সংগ্রাম’, ‘বেদনার নীল পদ্মা’। চরাঞ্চল ও হাওরবাসীদের জীবন ও সংগ্রাম উঠে এসেছে তার কলমের ছোঁয়ায়। বই লিখেছেন ‘হাওরবাসীর জীবনকথা’।
হাওর অঞ্চল থেকে অনেক কবি-শিল্পী গীতিকার উঠে এসেছেন। তাদের গান আমাদের মুখে মুখে। কিন্তু শেলীর ভাষায় বলতে হয় ‘আমাদের বিষাদের গানই সবচেয়ে সুমধুর গান’(Our sweetest songs are those tell our saddest thoughts)।
কবিতা বা গানের স্নিগ্ধতা নয় হাওরবাসীদের ‘গদ্যময়’ জীবনের গল্প শুনতে চলে আসুন আগামী লেকচার ‘হাওরবাসীর জীবনকথা’য়। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য বাংলাদেশে এএসএম ইউনুছের চেয়ে বিশ্বস্ত ও যোগ্যতর লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
The post বিজয়ের মাসে ‘বাংলাদেশ পাঠ সিরিজ’ শুরু স্টাডি ফোরামের appeared first on Bangladesh Study Forum.
The word ‘Haor’(wetlands) in bangla origins from the word ‘Sagar’(sea). By the course of time the word ‘Sagar’(sea) changes into ‘sayor’ and then took the form ‘Haor’ and as a dialect people pronounce it ‘Aaor’. Through people’s everyday use of the language the ‘sh’ sound was replaced by the ‘h’ sound and the ‘h’ sound is replaced by the ‘a’ sound.The wetlands area remains under water for 6 months during the rainy season and in summer when the level of water decreases they look like islands. In the period of East Pakistan Sylhet and Sunamgonj were a part of Asam. The wetlands area of Bangladesh covers 7 Jilla , 52 Upajilla, with an area of 2500 square kilometer in total.
The history of the origin of the wetland area is divided into two different schools of opinions, one of which says that it emerges from the sea. The fossils of oysters and other sea fishes and animals proof so. Another says that a serious earth quake changes the landscape. Astagram is such a big wetlandthat it seems like Bay of Bengal in the rainy season. Hakaluki is the biggest wetland of Bangladesh. There are near about 376 wetlands in total in Bangladesh. Chinese traveller Hsüan-tsang says that the East and West area of Bangla (present Bangladesh) had a huge water flow but he did not mention or referred it as a sea.
Ananta Kastul is the first person who came here and founded the Kastul village. Among the inhabitants of wetlands area there are Hajong, Koch, Khasia who lives in the village Astagram and of different races. The Malonia land was under the Khasia and the present Netrokona Jilla was under Koch. The Koches had their own source of water as every Koch house had their won ponds and lakes. There were 1992 ponds in total. There were a prominent number of Koch temples of which some have survived till now,
The inhabitants of the wetlands area suffers with many problems. The rainy season remains there for six months and boat is the only transportation then. In late Autumn the roads are dry and people can walk on foot. Again for later 2 months people neither can walk on foot nor can use the boat because of extensive muddy roads and lands.
In every fiscal year, Govt put a fund of 20,26,00,000 almost of which is returned back. This happens because the bill passed in Jun-July comes to the hand of administration in January when the water level starts rising and therefore the money has no works.
The general hospital is about 11 kilometer far from the villages which takes 5/6 hours to reach. So during the pregnancy period, the mothers suffers so badly.
The education system of the wetlands area is so poor and bad in condition. In harvest time there is no students and no teachers. From January 20 to February 20, it is school holiday for the students.
Boro rice is the main corps of wetlands area. Though 1/5 rice of Bangladesh comes from the wetlands area, the Govt has no strong steps to help the farmers. When the ripe paddy goes under water they have no place to keep the paddy.
In 1947, after the partition of India-Pakistan, Sylhet becomes a part of Bangladesh. The cut down of trees and mountains in that time of that area has its bad impact till now. The rain water brings a huge amount of sands which is changing the fertility of the lands. Once in a rainy season 72 villages, 21 primary schools, 9 temples washed away with the huge flow of water.
The 1/10 portion fishes of Bangladesh comes from wetlands area but the power and the hierarchy system along with the lease system of the capitalist market keeps the fishermen poor. The kaybarta( fishermen) races came here relaying on fishes. Every year the ‘Jalmahal’ (lease) system creates internal conflicts among the powered parties as a result of which 10/11 murder takes place there repeatedly in every year.
The ‘Afgan” people started the ‘Dadan’ (loan) system here first which is continued to till now by the teachers and other capitalists.Sher – e Bangla A. K. Fajlul Haque stopped this system for a certain period but now there is no other system without it
The unplanned construction of bridge and culverts breaks the flow of water and therefore the lands emerge in the rivers which is badly in need to be dug. There are 24 rivers which has no water now because of it. The roads and transportations need to be developed with a well planned way.
The Govt. budget needs to be fixed for a certain time keeping balances with the geographical conditions and situations.The Tipaimukhi Badh (a dam) also puts a large and long term negative impact on the area.
This bare situations and conditions of the wetlands area needs attention of the mainstream society so that their acute problem will come into light. Writer Humayun Ahmed wrote his novel Magic Munshi when he practically watched and realizes the unbearable conditions and situations of those areas.
This note is based on a 43rd public lecture of BDSF on “Haorbaseer Jibonkotha” given by ASM Younus, who has worked there for 2 and a half years more. After a research on those wetlands area and the people there he has written a book Haorbaseer Jibonkotha.
Nushrat Jahan Sinthia
Head of Documentation, Bangladesh Study Forum (BDSF)
The post ASM Younus’s Haorbaseer Jibonkotha appeared first on Bangladesh Study Forum.
সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা, বিজ্ঞান, রাজনীতি ও ইতিহাস চর্চা, বিকাশ ও প্রসারে এথেন্সের নাম খুবই গৌরবের সাথে গত আড়াই হাজার বছর ধরেই সম্মান ও সমীহের সাথে উচ্চারিত ও আলোচিত হয়ে আসছে। প্রতিবেশী গ্রীক রাজ্য স্পার্টা শুধু সামরিক কলার দিকেই মনোযোগ দিয়েছিল এবং এথেন্সের সেই জ্ঞান ও দর্শন চর্চাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো।কিন্তু কয়েক হাজার বছর পর দেখা গেল স্পার্টার গৌরবের শুধু কঙ্কালই পড়ে রয়েছে। সেখান থেকে স্পার্টার একটা স্পষ্ট রূপ আমরা বের করতে পারছিনা। অপরদিকে এথেন্সের উত্থান,পতন, জয়-পরাজয় থাকলেও জ্ঞান-চর্চা, দর্শন ও শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে সবচেয়ে সম্মানের মুকুট দেয়া হয় এথেন্সকেই। দর্শনে সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল বা সাহিত্যে ইউরিপিদিস, সফোক্লিস, অ্যারিস্টোফেনিস এবং রাষ্ট্রনীতিতে সিসেরো, ডেমোস্থিনিস বা পেরিক্লিসের নাম জ্বলজ্বল করছে ইতিহাসের পাতায়।
একটা জাতি, সম্প্রদায়, আদিকালের নগররাষ্ট্র বা এখনকার জাতিরাষ্ট্র কিভাবে আত্মসম্মান নিয়ে বিশ্বমহলে দাড়ায়? এটা জানার জন্য ইতিহাসের শীষ্যত্ব নিয়েছি। জানার-বুঝার চেষ্টা করছি কিভাবে একটা জাতি বা রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হতে হয় মনে-মগজে-মাথায় শুধু সামরিক শক্তি নয়, অর্থনৈতিক উল্লম্ফনই নয়। বিশ্বের বিভিন্ন সভ্যতার উত্থান-পতনের ইতিহাসের উপর দিয়ে উড়ছি আর দেখছি পরম বিস্ময়ে কিভাবে আমাদের আগে আমাদের পূর্বসুরীরা পৃথিবী কাপিয়ে বেরিয়েছে।
সেই ধারাবাহিকতায় প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার রাণী এথেন্সের উত্থান ও বিকাশের কারণ জানার চেষ্টা করেছি। সম্প্রতি পড়া একটা বইয়ে তার কারণটা একটি প্যারাতেই পেয়েছি।
তার পেছনে যে কারণটা উঠে এসেছে সেটা এককথায় প্রকাশ করলে এমন হয়-“Talent, money, freedom and an interested critical public created an ideal environment for major achievements in the fields of architecture, the visual arts, literature and philosophy.” (p 120, An Introduction to the Ancient World by L. De Blois and R.J. Van Der Spek)
বইটির নাম “An Introduction to the Ancient World by L. De Blois and R.J. Van Der Spek” বিশ্বখ্যাত Routledge প্রকাশনীর এই বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে পড়তে চাইলে এই কল নাম্বার মনে রাখতে পারেন: 901.9FOO
এথেন্সের উত্থান, বিকাশের পেছনে যে কারণ বা শর্তের কথা লেখকদ্বয় তুলে ধরেছেন তাদের বইটিতে সেগুলো অন্যান্য সভ্যতার উত্থানের পেছনেও প্রয়োজনীয় শর্ত বলে মনে করি।
পাঠকের ডায়রী, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৫
The post কোন সভ্যতার উত্থানের পেছনের কারণ কি? appeared first on Bangladesh Study Forum.
স্কুল থেকে পালানোর দুটো কারণ হতে পারে:
এক, স্কুলের শিক্ষা আর ভালো লাগেনা বা স্কুলে পড়তে আগ্রহ তৈরি করা যাচ্ছেনা,
দুই, নতুন স্কুল তৈরি করা!
পৃথিবীর ইতিহাসে স্কুল পালানো মহান ব্যক্তিত্বদের সংখ্যা কোন কালেই কম ছিলনা। কি কারণে স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মহান প্রতিভাধর ব্যক্তিরা থাকতে পারেনা এটা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। অনেকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলার সাথে খাপ খাওয়াতে পারেনা অথবা প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসকে অপূর্ণ বা কম মনে করে। আবার কেউ এই বিশ্ব নামের উন্মুক্ত শিক্ষাঙ্গনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। তাই শৃঙ্খলার আলয় থেকে বের হয়ে যায় স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে। প্রমথ চৌধুরীর ‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত’ এ কথাটি মনে করে দেয় বারবার। স্কুল পালানো স্বশিক্ষিত লোকেরা এমনই মহীরুহে পরিণত হন যে তাদেরকে ঘীড়ে স্কুল গড়ে উঠে। আমরা যুগে যুগে স্কুল পালানো এমন বিশ বিশ্বসেরা ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হবো। টাইমস অব ইন্ডিয়া অবলম্বনে লেখাটি প্রস্তুত করেছেন সাবিদিন ইব্রাহিম।
১. স্মৃতি ইরানি
স্কুল নিয়ে নতুন করে বিতর্ক উঠে আসলে ভারতের নবনিযুক্ত মন্ত্রী মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিকে নিয়ে। কংগ্রেস তাকে নিয়ে সমালোচনা করে যে সে একজন গ্র্যাজুয়েটও নয় সে কিভাবে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় চালাবে? এর জবাবে বৃহস্পতিবার নীরবতা ভেঙেছেন স্মৃতি ইরানি। তিনি অনুরোধ করেন তাকে যেন তার কাজের দ্বারা মূল্যায়ন করেন তার সার্টিফিকেট দিয়ে নয়। এ সূত্রেই টাইমস অব ইন্ডিয়া বিশ্বসেরা ব্যক্তিত্বদের কথা এনেছে যারা কোন ধরণের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বা অল্প আনুষ্ঠানিক শিক্ষা দিয়েই জীবনে সফলতার চূড়ায় পৌছেছিলেন।
২. উইন্সটন চার্চিল
স্কুলে মারামারি আর দাঙ্গাবাজির জন্য কুখ্যাত ছিলেন উইন্সটন চার্চিল। পড়ার চেয়ে মারপিটের জন্যই বিখ্যাত ছিলেন স্কুলে। স্কুল কোন মতে শেষ করেই মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হয়ে যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অতি সাধারণ একজন প্রতিবেদকের কাজ করেছিলেন এবং জার্মান সেনাদের হাতে আটকও হয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই স্কুল পালানো ছেলেটিই ইংল্যান্ডের ক্রান্তিকালীন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। তার অসাধারণ নেতৃত্ব ও অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্বের কারণেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড জার্মানীর মোকাবিলা করতে পেরেছিল এবং ব্রিটেনের মান বাঁচিয়েছিল। চার্চিলই একমাত্র রাজনীতিবিদ যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
৩. জর্জ ওয়াশিংটন
স্কুল শেষ করতে পারেননি জর্জ ওয়াশিংটন। বাবার মৃত্যুর পর পড়াশুনা শেষ না করেই স্কুল থেকে ইস্তফা দেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। আমেরিকানরা পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাদের জাতির জনক ওয়াশিংটনকে যিনি আসলে স্কুল শেষ করতে পারেননি!
৪. আব্রাহাম লিংকন
মোটাদাগে তিনি ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত লোক। ছোটবেলায় যে স্কুলে তিনি পড়তে যেতেন সেখানে আশেপাশের আট দশ কিলোমিটারের মধ্যে লিংকনই ছিল একমাত্র ছাত্র। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ঐ অর্থে বেশি করতে পারেননি। বেশিরভাগই নিজে নিজে শিখেছেন। তিনি আইনজীবি হয়েছিলেন, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন যিনি দাসপ্রথার উচ্ছেদ করেছিলেন এবং আমেরিকার আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিলেন। আমেরিকার সর্বকালের শ্রেষ্ঠ একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গড়ে উঠার পেছনে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার ভূমিকা খুব কমই!
৫. ইন্ধিরা গান্ধী
বেশিরভাগ সময়ই বাসায় গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশুনা করেছিলেন। আর তার প্রধান শিক্ষক ছিলেন তার বাবা জওহারলাল নেহরু। মেয়ের কাছে লেখা নেহরুর চিঠিগুলো বিশ্বের যেকোন প্রান্তে থাকা প্রত্যেকটি শিশুর জন্য অবশ্য পাঠ্য বিষয় হতে পারে। ইন্ধিরা পরবর্তীতে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আবার অক্সফোর্ডেও পড়তে যান। কিন্তু কোনটাতেই পড়া শেষ করতে পারেন নাই। কিন্তু ইন্ধিরা গান্ধী ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন।
৬. জেন অস্টিন
অস্টিন মাত্র এগারো বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে দেন। কারণ তার পরিবার তার লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছিলনা। কিন্তু এই মেয়েটিই পরবর্তীতে ইংরেজি সাহিত্যের সেরা ঔপন্যাসিকদের একজন হতে পেরেছিলেন।
৭. মার্ক টুয়েন
মার্ক টুয়েন মাত্র ১২ বছর বয়সে স্কুল থেকে ইস্তফা দেন। কারণ পরিবারে সাহায্য করার জন্য তখন থেকেই একজন প্রিন্টারের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। তিনি পরবর্তীতে সর্বকালের একজন সেরা লেখক হতে পেরেছিলেন।
৮. চার্লস ডিকেন্স
চার্লস ডিকেন্সও স্কুল ছাড়েন মাত্র বার বছর বয়সে। ঋনদায়গ্রস্ত পিতা জেলে পড়ার কারণে পরিবারের ভার এসে পরে এই ছোট্ট ছেলের কাঁধে। এ কারণে আর স্কুল শেষ করতে পারেননি। তিনি বিশ্বের সর্বকালের সেরা ঔপন্যাসিক হয়েছিলেন। জীবদ্দশাতে ও মৃত্যুর পর তার মত জনপ্রিয়তা খুব কম লেখকই পেয়েছিলেন।
৯. উইলিয়াম শেক্সপীয়র
গ্রামার স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনা ছাড়া আর তেমন আনুষ্ঠানিক পড়াশুনার সৌভাগ্য হয়নি তার। লন্ডনের নাটকের মঞ্চ আর জীবনের মঞ্চেই সব শিক্ষা সমাপ্ত করেছেন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব তাকে ইংরেজি সাহিত্যের সেরা নাট্যকার, সেরা কবি হতে বিরত রাখতে পারেনি। কার্লাইলের ভাষায় তাকে বলায় যায়, ‘তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চেয়েও বড়’।
১০. লিও টলস্টয়
বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করতে পারেননি রাশিয়ান এই ভদ্রলোক। ‘ওয়ার এন্ড পিস’ ও ‘আনা কারেনিনা’র লেখক টলস্টয় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে সমাদৃত।
১১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কোথাও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করতে পারেননি। দেশে স্কুল শেষ করেননি। আবার বিলেত গিয়েও পড়াশুনা শেষ না করে চলে আসেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিভা নির্দ্বিধায়। তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অনুপস্থিতি এক্ষেত্রে বাধা হিসেবে দাড়ায়নি।
১২. ক্রিস্টোফার কলম্বাস
মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সেই সাগরের পথে নেমে যান আর আনুষ্ঠানিক পড়াশুনার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু চল্লিশের কোঠাতেই আমেরিকা আবিষ্কার করে ফেলেন।
১৩. জর্জ ইস্টম্যান
পরিবারকে সাহায্য করার জন্য মাত্র ১৬ বছর বয়সেই স্কুল ছেড়ে দেন। ত্রিশ বছরের দিকে ক্যামেরার রুল ফিল্ম আবিষ্কার করে ফেলেন। ৩৮ বছর বয়সে ইস্টম্যান কোডাক প্রতিষ্ঠা করেন। আজ সারাবিশ্বে কোডাক একটি জনপ্রিয় নাম।
১৪. থমাস আলভা এডিসন
স্কুল পালানোদের মধ্যে এডিসনের নাম ব্যাপক আলোচিত। তাকে স্কুল থেকে অনেকটা বেরই করে দেয়া হয়। তার আজগুবি সব প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত শিক্ষকেরা তাকে বিদায় করাতেই সমাধান খুজে পেয়েছিলেন। কিন্তু মমতাময়ী মায়ের আশ্রয়ে তার পড়াশুনা চলে। বিশ্বের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী হয়েছিলেন এডিসন যারা অসংখ্য আবিষ্কারের মধ্যে ইলেকট্রিক বাতি, গ্রামোফোন উল্লেখযোগ্য।
১৫. বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন
আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ফ্রাংকলিন মাত্র ১০ বছর বয়সেই স্কুল ছাড়েন। ভাইয়ের প্রিন্টিং কারখানায় কাজ শুরু করে দিয়ে পরিবারকে সাহায্য করা শুরু করেন। তিনি ছিলেন একজন অসাধারন লেখক, কূটনীতিক, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক এবং রাজনীতিবিদ। এই বহুমুখী প্রতিভার বিকাশে স্কুল পড়া শেষ না করা কোন ভূমিকা রাখেনি।
১৬. গৌতম আদানি
ভারতের অন্যতম বৃহত্তম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানি বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। দুবছরের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া আর তেমন পড়াশুনা করতে পারেননি আদানি।
১৭. ধীরুভাই আম্বানি
আম্বানি কোনমতে স্কুল শেষ করতে পেরেছিলেন। এর পরে আর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তার প্রতিষ্ঠিত রিলায়েন্স গ্রুপ ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
১৮. রিচার্ড ব্রানসন্
এই ব্রিটিশ বিলিয়নার মাত্র ১৬ বছর বয়সেই পড়াশুনা ছেড়ে দেন ব্যবসা শুরু করার জন্য। খ্যাতিমান ধনকুবেরদের মধ্যে তার নাম উপরের দিকেই আসে। তাছাড়া তার ব্লগে লেখা অনুপ্রেরণাদায়ী লেখাপত্র ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে বিশ্বজোড়া পাঠকমহলে।
১৯. বিল গেটস
মাত্র বিশ বছর বয়সে পড়াশুনা শেষ না করেই হার্ভার্ড থেকে বের হয়ে আসেন বিল গেটস। তার সহযোগী পল অ্যালেন ও ড্রপআউট। দুজনে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন মাইক্রোসফট্। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছেন।
২০. ওয়াল্ট ডিজনি
মিকি মাউসের স্রষ্টা ওয়াল্ট ডিজনি এইটথ্ গ্রেডেই পড়াশুনার ইস্তফা দেন। ডিজনি ল্যান্ড তৈরি করেন যা আজ বিশ্বজোড়া পর্যটকদের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু। অসংখ্য সফল সিনেমার পরিচালক, অ্যানিমেশনকে নতুন স্তরে নিয়ে যাওয়ার অগ্রদূত ওয়াল্ট ডিজনির বড় হওয়ার পথে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব বাঁধা হিসেবে দাঁড়ায়নি।
সাবিদিন ইব্রাহিম
sabidin@bdsfbd.com
The post স্কুল পালানো বিশ বিশ্বসেরা ব্যক্তিত্ব appeared first on Bangladesh Study Forum.
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়ে তার ব্যাপক ভালোবাসা ছিল। তিনি তাকে অনেক উচ্চে স্থান দেন। নীরদের কাছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘মহাপুরুষ বঙ্কিম’। পাশ্চাত্য জগতে ‘গ্রেট ম্যান’ বলতে যা বুঝায় তিনি তাই।
এ নিয়ে নীরদের মত হচ্ছে,
“বাঙালির ভারতব্যাপী প্রতিষ্ঠা প্রথম চৈতন্যদেবের দ্বারা হয়। উহার চেয়েও বড় প্রতিষ্ঠা ঊনবিংশ শতাব্দীতে যাঁহাদের দ্বারা হইয়াছিল সেই বাঙালিদের মধ্যে বঙ্কিমকে প্রধান বলা যাইতে পারে।” (নির্বাচিত প্রবন্ধ, পৃষ্ঠা ৯৯)
শ্রেষ্ঠ বাঙালি কে?
১৯৮৮ সনের ৩ জুলাই আনন্দবাজার পত্রিকায় বঙ্কিমকে নিয়ে লিখতে গিয়ে নীরদ লিখেন:
“বাঙালির সমগ্র ইতিহাসে বাঙালি হিসাবে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ তিনি রবীন্দ্রনাথ, তাঁহার অপেক্ষা বড় বাঙালি জন্মে নাই, জন্মিবেও না।..তাঁহার পরেই বঙ্কিমচন্দ্র, কেশবচন্দ্র সেন, বিবেকানন্দ, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও সুভাষচন্দ্র বসু। “
রবীন্দ্রনাথের চেয়ে ‘বড় বাঙালি জন্মে নাই, জন্মিবেও না’- এ কথাটি বলে নীরদ ভবিষ্যতের প্রতি অন্যায় করেছেন! রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই জন্মাবেনা, কেউই পুনর্জন্ম লাভ করেনা বা তার দরকারই নেই কিন্তু তার মানের বা তার চেয়ে বড় কেউ জন্মাবেনা এটা একজন ভক্তের পত্রিকা কলাম হিসাবেই নিলাম, ঐতিহাসিক ও নাক উঁচা লেখক নীরদ থেকে নিলাম না।
৬ শ্রেষ্ঠ বাঙালি
চারটি ক্যাটাগরিতে ৬ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকা করেছেন নীরদ সি চৌধুরী।
১. রবীন্দ্রনাথ, মহাকবি, শ্রেষ্ঠ কবি। শুধু বাংলা ভাষায় নয় বিশ্বের যেকোন ভাষার শ্রেষ্ঠ কবির যোগ্যতা আছে রবীন্দ্রনাথের। তিনি সত্যিকার অর্থেই বিশ্বকবি।
২. শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তারা বিশ্বমানের সেরা ঔপন্যাসিক।
৩. শক্তিমান ধর্মপ্রচারক: কেশবচন্দ্র সেন ও বিবেকানন্দ
৪. আত্মবলিদানকারি নেতা: সুভাষচন্দ্র বসু
তার এই ৬ জন শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ঈশ্বরচন্দ্রের অনুপস্থিতি অনেকেরই সমালোচনার কারণ হয়েছিল। তিনি এর জবাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিয়ে অনেক লিখেছেনও। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নিয়ে তার মনোভাব হচ্ছে ঈশ্বরচন্দ্র মহাপুরুষ নি:সন্দেহে কিন্তু তিনি শ্রেষ্ঠ বাঙালি নন।
শ্রীযুক্ত প্রমথ চৌধুরী
তাকে একটু বেশি গালি দিবেন বলেই হয়তো তার প্রবন্ধের শিরোনামটি এমন রেখেছিলেন। প্রমথ চৌধুরী নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন নীরদ চৌধুরী। ওখানে প্রমথের প্রশংসার চেয়ে সমালোচনার ভার অনেক বেশি। প্রমথভক্ত ও সুধীমহলে ওগুলো বেশ সমালোচনার কারণ হয়। শুধু একটু অংশ তুলে ধরি:
“…তবুও প্রমথবাবুর জীবন একটা ট্র্যাজেডি। প্রমথবাবু ‘পলিটিকস্, ইকনমিকস্, শিক্ষা, সমাজ, হিন্দুধর্ম্ম, ইসলামধর্ম্ম ইত্যাদি যেকোন একটা অথবা সবকটা নিয়ে অতি গম্ভীর ও অতি রাগতভাবে নানারূপ প্রভু-সম্মত বাণী ঘোষণা করিতে পারেন না, ইহাই তাঁহার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি নয়। তাঁহার জীবনের ট্র্যাজেডি ইহাই- যে এই বৈদগ্ধ্যবর্জিত বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করার ফলে অতি ক্ষুদ্র বিষয়ে তাঁহার অতি তুচ্ছ রসিকতাকেও লোক একটা গুরুগম্ভীর দার্শনিক তত্ত্ব বলিয়া ভুল করিয়া বসে।”
আত্মঘাতী বাঙালী ও আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রচর্চার বর্তমান হালহাকিকত বলতে গিয়ে নীরদ তার ভূমিকায় বলেন ,
“বর্তমানে অবশ্য অবস্থাটা উল্টা হইয়াছে, অর্থাৎ রবীন্দ্রনিন্দকেরা লোপ না পাইলেও রবীন্দ্রভক্তেরাই প্রবল হইয়াছে। কিন্তু না ভক্তি না নিন্দা, কোনটাই উচ্চস্তরে উঠে নাই। এখনও রবীন্দ্রনাথের সত্য রূপ আত্মপ্রকাশ করিতে পারিতেছে না।
আমি সারাজীবন সেই রূপটি ধরিবার চেষ্টা করিয়াছি, মনে হয় অবশেষে হয়ত ধরিতেও পারিয়াছি। তবে আমার ধারণায় তাঁহার যে রূপ আসিয়াছে উহা এক নয়, দ্বিধাবিভক্ত। উহার একদিক আত্মসমাহিত রবীন্দ্রনাথের, অন্যদিক আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথের। এই দুই রূপের অবিচ্ছিন্নতাই তাঁহার জীবনের বৈশিষ্ট্য।” (আত্মঘাতী বাঙালী ও আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, পৃষ্ঠা ৩, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স)
নীরদের এই আত্মবিশ্বাস ও দু:সাহসকে সাধুবাদ না জানানোর উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তার অনন্য মতামত ঈর্ষা, হিংসা বা বিদ্বেষপ্রসূত নয়। এটা রবীন্দ্রনাথকে explore করে আসল রূপটি ধরার ইংরেজ বা ইউরোপীয় সুলভ বৈশিষ্ট্য।
ক্ষুধিত পঙ্কে রবীন্দ্রনাথ
অনেক প্রতিভাধর বাঙালী জন্মেছেন কিন্তু একটা সীমা পর্যন্ত গিয়ে কেন আর আগাতে পারে না তার পোস্ট মর্টেম করার চেষ্টা করেছেন নীরদ। মহাভারতের কর্নের চাকা যেমন বালুতে আটকে যায় তেমনি যেন বাঙালির উর্ধ গমন একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বা একটা জায়গায় গিয়ে পঙ্কিল হয়ে যায়। এমনকি অনেক বড় বড় ব্যক্তিত্বও সেই ক্ষুধিত পঙ্ক থেকে বাঁচতে পারেনি। নীরদের জবানিতে:
“… যাঁহাদের প্রতিভা সম্বন্ধে সন্দেহ করা চলেনা-তাঁহারাও এই পঙ্কে ডুবিয়াছেন। কয়েকজনের উল্লেখ করিব-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্র বসু, পাণ্ডিত্যে হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী ও দেবপ্রসাদ ঘোষ, সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রেমেন্দ্র, শৈলজানন্দ ও হুমায়ুন কবীর। ইহাদের কেহই প্রভাতে উদিত হইয়া মধ্যাহ্নের আকাশ পর্যন্ত যান নাই। বুদ্ধদেব বসু সম্বন্ধেও তাহাই বলিব, তাহাকে শুধু বাঙালী জীবনের মানসিক ক্ষুধিত পঙ্কই গ্রাস করে নাই, যাদবপুরের বাধাও তাঁহাকে কবিপদ হইতে অধ্যাপকপদে নামাইয়াছিল। মরণং যাদবপুরে, অপরং বা কিং ভবিষ্যতি।
আরও অনেকের কথা বলিতে পারিতাম, তবে তালিকা বৃদ্ধি না করিয়া, যিনি আমার তালিকার শীর্ষে, অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ, তাঁহার দশাই দেখিব। তাঁহার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভাবে ক্ষুধিত পঙ্ক গ্রাস করিতে নিশ্চয়ই পারে নাই; কিন্তু তাঁহার জীবনকে, গ্রাস করিতে না পারিলেও দু:খের বিষে জর্জরিত করিয়াছিল। উহার আকর্ষণ হইতে নিজেকে বাঁচাইবার জন্য তিনি যে সংগ্রাম করিয়াছিলেন, তাহাতে তিনি যেন পাগল হইয়া গিয়াছিলেন। স্বজাতির আচরণ সম্বন্ধে তিনি যৌবন হতে বার্ধ্ক্য পর্যন্ত যেসব উক্তি করিয়াছিলেন তাহা যেন পাগল মেহের আলির ‘তফাৎ যাও, তফাঁ যাও’ চীৎকারের মত। শেষ পর্যন্ত ক্ষুধিত পঙ্ক তাঁহার জীবনকে ক্লান্তিতে অবসন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল, কিন্তু উহার অন্তর্নিহিত মহত্ত্ব ও সেই মহত্ত্বের সাহিত্যিক প্রকাশকে নষ্ট করিতে পারে নাই-তবু উহাকে জীবনব্যাপী দু:খের সহিত জড়িত করিয়া রাখিয়াছিল। সেজন্য এককালে আমি তাঁহার সাহিত্যসৃষ্টিকে ‘les fleurs du mal’ বলিতাম। এত মহান্ ও এত বহুমুখীন প্রতিভাবান ব্যক্তির এমন দু:খময় জীবনের কথা আমি কোনো দেশের সাহিত্যিক ইতিহাসে পড়ি নাই।”
(আত্মঘাতী বাঙালী ও আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ, শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী, পৃষ্ঠা:৫)
সাবিদিন ইব্রাহিম
sabidin@bdsfbd.com
The post কতিপয় বাঙালি নিয়ে নীরদ চৌধুরীর মূল্যায়ন appeared first on Bangladesh Study Forum.
ঢাকা ইউনিভার্সিটি কুইজ সোসাইটিতে প্রদত্ত বক্তৃতা
বক্তা: সাবিদিন ইব্রাহিম
ডাকসু ভবন, দ্বিতীয় তলা-২৭ জানুয়ারি, ২০১৬
ইতিহাস কি? এটা কি শুধু কিছু দিন তারিখ আর সালের সমাহার? নাকি এর চেয়েও বেশি কিছু! I think history is not merely about some dates and years rather it is about events and the stories behind those events.
আমরা আজকে শুধু কিছু বোরিং সাল তারিখই জানবো না বরং সেসব সাল তারিখ আলোচিত, আলোকিত বা সমালোচিত ও কলঙ্কিত হওয়ার পেছনের গল্প, পেছনের ঘটনা এবং সেসব ঘটনার পেছনের গল্পও বলার চেষ্টা করবো।
আলোচনার প্রথমে ইতিহাস মনে রাখার একটা সহজ তরিকা আপনাদের সাথে শেয়ার করি।
The name English derived from the Angles, and the names of the countries Essex, Sussex, and Wessex refer to the territories occupied by the East, South and West Saxons.
ইতিহাসের বিভিন্ন ঘটনাগুলোকে মনে রাখার জন্য মুক্তার মালা বা ফুলের মালা তার ছবিটা মনে রাখতে পারেন। একটা সুতা পুরো মালাটা আটকে রাখে। সুতাটা কেটে দিলে যেমন সবগুলো দানা এক এক করে পরে যায় তেমনি ইতিহাসের সেই সুতাটা না ধরতে পারলে পুরো বিশ্ব ইতিহাসের এক একটি ঘটনাকে এক একটি সম্পর্কহীন দানা মনে হবে। আবার এই সুতাটা ধরতে পারলেই সমগ্র বিশ্বইতিহাসকে একটি মালায় নিয়ে আসা সম্ভবপর হবে।
আবার এই যে মুক্তার মালা, তার শুরু বা শেষ কোনটা এটা নির্ধারণ করা কিন্তু অসম্ভব। যেকোন জায়গা থেকে শুরু করে আপনি পুরো মালাটার উপর দিয়ে ঘুরে আসতে পারবেন। বিশ্ব ইতিহাস বা যেকোন জাতি বা সম্প্রদায় বা রাষ্ট্রের ইতিহাস জানার জন্য যেকোন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছুইলেই আপনি পুরো ইতিহাসের উপর ঘুরে আসতে পারবেন।
ইংরেজি সাহিত্যে কি এমন কোন একক উপন্যাস কি আছে যা রুশ লেখক লিও টলস্টয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’ বা ফরাসী লেখক গস্তাভ ফ্লুবার্ট এর ‘মাদাম বোবারি’র মতো বিশ্বজনীন? এই প্রশ্ন বিশ্বসাহিত্যের অনেক সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটানিকাতেও উল্লেখ থাকে।
“It can be argued that no single English novel attain the universality of the Russian writer Leo Tolstoy’s ‘War and Peace’ or the French writer Gustave Flaubert’s ‘Madame Bovary.”
(Entry: English Literature, Encyclopaedia of Britanica, V-18, page-426)
আরেকটা জিনিস মনে রাখতে হবে: এই বিশ শতকের সব সেরা ইংরেজি গদ্য লেখকরা কিন্তু ইংল্যান্ডের মূল ভূমির বাইরের! এ কালের সালমান রাশদী থেকে শুরু করে ভিএস নাইপাল বা হেনরী জেমস থেকে জোসেফ কনরাড কেউই মূল ইংল্যান্ডের নয়।
ইংরেজ ও ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে কথা বলার প্রাসঙ্গিকতা কি? তাদের সাথে আমাদের কি ভাই না ভাসুরের সম্পর্ক এ নিয়ে অনেকেই কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে নীরদ, নজরুল থেকে গোলাম মুরশিদ। আমাদের অতীত, বর্তমানের সম্পর্ক কখনোই এক স্বাদের ছিল না। বরং অম্ল-মধুর, তেতো-জ্বাল সবই। বাংলা সাহিত্যের সেরা প্রতিভা রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি:
“তখন ইংরেজি ভাষার ভিতর দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যকে জানা ও উপভোগ করা ছিলার্জিতমনা বৈদগ্ধ্যের পরিচয়। দিনরাতি মুখরিত ছিল বার্কের বাগ্মিতায়, মেকলের ভাষাপ্রবাহের তরঙ্গভঙ্গে; নিয়তই আলোচনা চলত শেক্সপিয়রের নাটক নিয়ে, বায়রনের কাব্য নিয়ে এবং তখনকার পলিটিক্সে সর্বমানবের বিজয়ঘোষণায়। তখন আমরা স্বজাতির স্বাধীনতার সাধনা আরম্ভ করেছিলুম, কিন্তু অন্তরে অন্তরে ছিল ইংরেজ ঔদার্যের প্রতি বিশ্বাস। সে বিশ্বাস এত গভীর ছিল যে একসময় আমাদের সাধকেরা স্থির করেছিলেন যে, এই বিজিত জাতির দাক্ষিণ্যের দ্বারাই প্রশস্ত হবে।” (সভ্যতার সংকট, র.ঠা.)
(কালান্তর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
আলোচনা মনে রাখার জন্য প্রথমেই প্রধান ভাগগুলো আপনাদের সামনে উল্লেখ করে নেই। ইংরেজি সাহিত্যের উল্লম্ফনকে মোটাদাগে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথমেই সেগুলোর উল্লেখ করে নেই।
স্কুল: বিভিন্ন গ্রুপের নামের পেছনের কথা, নামকরণের কারণ-বিত্তান্ত
একটি নির্দিষ্ট সময়কালে লেখক-কবি-চিন্তকদের মধ্যে চিন্তা, প্রকরণ বা ধরণের মিল খুজে পায় পরবর্তী সময়ের লেখক-কবি-চিন্তকগন। তাদের পূর্বসূরীদের সহজে একনামে ডাকার জন্য একটা কমন নাম দেয়ার চেষ্টা শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে একটি সাধারণ ট্রেন্ড। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসেও আমরা এমন অনেকগুলো যুগ, অনেকগুলো স্কুলের সাথে পরিচিত হবো। রোমান্টিক কবিদের একজনও জানতেন না তারা রোমান্টিক ধারায় পড়েছেন। গথিক ঔপন্যাসিকরাও জানতেন না তারা একটি বিশেষ ধারায় পড়ে যাচ্ছেন। গ্রেইভইয়ার্ড স্কুল নামে যারা পরিচিত হয়েছিলেন তারাও জানতেন না যে এই নামে তারা পরিচিত হবেন!
স্পেন্সারের মত করে যারা কবিতা লিখছিল তারা স্পেন্সারিয়ান কবিদের দলভুক্ত হয়ে গেলেন। মেটাফিজিক্যাল কবিরাও নিজেদেরকে এই নামে পাবেন বলে ভাবেন নি।
তারপরও আলোচনার সুবিধার্থে ইংরেজি সাহিত্যের সর্বজন গৃহীত যুগ বিভাজনকে তুলে আনি:
Title | Duration | ||||||||
The Anglo-Saxon Period | 449-1066 | ||||||||
The Middle Ages | 1066-1485 | ||||||||
The Renaissance | 1485-1660
|
||||||||
The Restoration and the Enlightenment | 1660-1798
|
||||||||
The Romantic Period | 1798-1832 | ||||||||
The Victorian Age | 1832-1901 | ||||||||
The Modern Era | 1901-present |
IMPORTANT AGES
Elizabethan age is the supreme age for England with comparison to other ages the history of England is divided into.
England for the first time in European history appeared as the leader in politics, literature and trade and commerce.
For politics, Queen Elizabeth was one of the shrewd politicians of all times and very successful administrator. It was the time of religious bigotry and confusion and difference among different Christian sects. She ablehandedly and with cunning and intelligence managed them all and even sometimes being too harsh.
Defeating the Spanish Armada in 1588 can be considered as one of her supreme achievements! It was such an important event in history that from then on England appeared as a powerful navy which ensured them as the leading country with colonies which comprised of the half of the world in the later centuries and their supremacy in navy was remain unchallenged until the second world war when USA took its place.
In literature this age was the most flourishing one. We can get rare example of such profuse production of various arts in a single age. It was the time of Christopher Marlowe,one of the finest playwright of world literature.
It was the time of Ben Johnson, a learned and well taught genius.
It was the time of Sir Philip Sidney,the perfect Elizabethan character in manifold diversity.
Above all, it was the time of the bard, William Shakespeare who sang such eternal songs the world is still mesmerized in getting the pleasure immortal and finding the meaning of those!
It was the time of Francis Bacon who pioneered the English prose who said things in precision and exactness and in extreme brief with epigrams and wits.
It was the age when England felt confident on her and the nation began to rise to rule the world for years ahead.
রাণী এলিজাবেথ: রাণী তার ভাষাজ্ঞান নিয়ে গর্ব করতেন। ফ্রেঞ্চ, ইতালিয় ভাষায় দক্ষ এবং গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় পড়তে পারতেন।
তিনি তার ভাষা সুন্দর করার জন্য হোরেস, সেনেকা, প্লুতার্ক, বোয়েথিয়াস, ক্যালভিন এমন কবি লেখকদের লেখা অনুবাদ করেছেন।কিছু অরিজিনাল কবিতাও লিখেছেন। তিনি অনেক সুন্দর বক্তৃতা প্রস্তুত করতেন। স্পিচ এট টিলবারি তার বিখ্যাত বক্তৃতা।
১৫৮৮ সালে স্পেনের আরমাদা ঠেকানোর জন্য সব ব্রিটিশ সেনার সাথে ইংলিশ চ্যানেল পর্যন্ত চলে আসেন রাণী প্রথম এলিজাবেথ। নিজেকে অনিরাপধ করে একেবারে সাধারণ সৈন্যদের মাঝে নেমে আসা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছিল তার অনেক উপদেষ্টা, শুভাকাঙ্খী। কিন্তু ব্রিটেনকে সবচেয়ে ভয়ানক পরাজয় ও লজ্জার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য রাণী এলিজাবেথ যে সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন তা আজও তাকে ব্রিটিশদের হৃদয়ে আসন দিয়ে রেখেছে। এজন্য আমরা তার বক্তৃতার শুরুতেই সে কথার উল্লেখ পাই যে তিনি বেশ নিরাপত্তা ঝুকি নিয়ে যুদ্ধ ময়দানে এসেছেন। তিনি তার উপদেষ্টাদের কথায় কর্ণপাত না করার পেছনে যুক্তি দেখিয়ে বলেন তিনি তার সৈন্যদের বিশ্বাস করেন।
“My loving people, we have been persuaded by some, that are careful of our safety, to take heed how we commit ourselves to armed multitudes, for fear of treachery; but I assure you, I do not desire to live to distrust my faithful and loving people. Let tyrants fear; I have always so behaved myself that, under God, I have placed my chiefest strength and safeguard in the loyal hearts and good will of my subjects. And therefore I am come amongst you at this time, not as for my recreation or sport, but being resolved, in the midst and heat of the battle, to live or die amongst you all; to lay down, for my God, and for my kingdom, and for my people, my honor and my blood, even the dust. “
তিনি যে একজন নারী এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে যে উক্তিটি করেন তা আজও সবার মুখে মুখে। তার কথাটি ছিল এমন, ‘আমি জানি আমার শরীর, নারীর দুর্বল শরীর কিন্তু আমার হৃদয় একজন রাণীর এবং সেটা ইংল্যান্ডের’। তিনি ব্রিটেনকে বহি:শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে নিজে অস্ত্র ধারণ করবেন এবং সৈন্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করবেন, ইংরেজ সেনাদের যুদ্ধে অবদানের বিচার ও পুরস্কার বিধান করবেন, যুদ্ধ মাঠের ধূলা গায়ে মাখবেন।
“I know I have the body but of a weak and feeble woman; but I have the heart and stomach of a king, and of a king of England too, and think foul scorn that Parma or Spain, or any prince of Europe, should dare to invade the borders of my realm; to which rather than any dishonour shall grow by me, I myself will take up arms, I myself will be your general, judge, and rewarder of every one of your virtues in the field. “
রাণীর মুখ থেকে প্রায় লক্ষাধিক সেনা এমন বক্তৃতা শোনার পর দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধে নেমেছিল। সে কারণ এবং আরেকটি প্রাকৃতিক কারণেই ব্রিটেন তার সূচনালগ্নে ভয়ানক এক পরাজয় থেকে বেঁচে যায়। রাণী প্রথম এলিজাবেথের এই বক্তৃতাটিকে ‘স্পিচ এট টিলবারি’ (টিলবারির বক্তৃতা) হিসেবে অভিহিত করা হয়।
তার সর্বশেষ বক্তৃতাটাতে ‘গোল্ডেন স্পিচ’ বলা হয়। তার শেষ লাইনটি এমন যার মাধ্যমে তিনি তার সমালোচকদের মুখ বন্ধ করতেন! “You bring them all to kiss my hand”(last line)
বিশ্ব ইতিহাসে নাড়া দেয়া কয়েকটি ঘটনার মধ্যে ফরাসী বিপ্লব অন্যতম। এটি সমকালীন চিন্তা-চেতনা, রাজনৈতিক ভাবনা, শিল্প-সাহিত্য, মানুষের মধ্যেকার সম্পর্ক সবগুলোকে নাড়া দিয়েছিল এবং নতুন করে ডিফাইন করেছিল। এ বিপ্লবের ঢেউ ইউরোপের সকল উপনিবেশ, তখন পর্যন্ত জানা সকল ভূখণ্ড ও জাতিগোষ্ঠির জীবনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল বা প্রভাবিত করেছিল। আর ফ্রান্সের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী, ক্লাসিক প্রতিপক্ষ গ্রেট ব্রিটেনকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে, সেটা পজিটিভ বা নেগেটিভ যেভাবেই হউক না কেন। শিল্প সাহিত্য ও রাজনীতির জগতে এটা প্রথম দিকে বেশ ঝাকি দিয়েছিল। ইংরেজি কবিতার রোমান্টিক যুগের পেছনে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক অনুপ্রেরণা ও অনুসঙ্গ হচ্ছে ফরাসী বিপ্লব। এডমান্ড বার্ক যেমন ফরাসী বিপ্লবের প্রথম বছরগুলোতেই এর বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা লিখেন, আবার তারই দেশের তরুণ কবি ফ্রান্স ভ্রমণ করে কাব্য মসলা নিয়ে আসেন যা দিয়ে কয়েক বছর পর কাব্যজগতে রোমান্টিক যুগকে আহ্বান করবেন।
বেশিরভাগ রোমান্টিক কবি লেখকদের ইমাজিনেশন (কল্পনা) দখল করে রেখেছিল ফরাসী বিপ্লবের ঘটনাবলী ও বিপ্লবের ধারণা। বিপ্লবের প্রথম দিকে একমাত্র এডমান্ড বার্ক ছাড়া সবাই তাকে সমর্থন ও সহমর্মিতা প্রকাশ করেছিল। রবার্ট বার্নস, উইলিয়াম ব্ল্যাক, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, সাউদি এবং ম্যারি ওলস্টোনক্রাফ্ট ছিলেন ফরাসী বিপ্লবের কঠিন সমর্থক। কিন্তু বিপ্লব পরবর্তী ভয়ংকর ঘটনাবলী তাদের পরের প্রজন্মকে বীতশ্রদ্ধ করে ফেলেছিল। এ ধারার মধ্যে পড়েন হ্যাজলিট, লি হান্ট, শ্যালী ও বায়রন। বিপ্লবের অনেক ভুল-ত্রুটি সত্ত্বেও ফরাসী বিপ্লব সর্বব্যাপী আশাবাদ ছড়িয়ে দেয় পুরো ইউরোপে। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে পুরনো জরাঝীর্ণ সমাজের শেষ দেখা যায় এবং নতুন সমাজ নির্মাণ করা যায়।
ফরাসী বিপ্লবের শিশু নেপোলিয়ন যৌবনে পৌছে ইউরোপে নতুন অর্ডারের আগমনী বার্তা দেন। প্রায় কমবেশি একযুগ সময়ে নেপোলিয়ন পুরো ইউরোপকে আরও শক্তিশালী ঝাকি দেন। ইতালী, স্পেন, পর্তুগাল জয় করেন; শক্তিশালী অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যকে করতলে নিয়ে আসেন। প্রিয় শত্রু ‘দোকানদারদের দেশ’(Country of Shoppers) ইংল্যান্ডকে পরাজিত করার চেষ্টা চালান। ফরাসী বিপ্লবের পর থেকে শুরু করে ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের পতনের আগ পর্যন্ত এই যে আড়াই দশক তখন গ্রেট ব্রিটেন কিন্তু বসে থাকেনি। ব্রিটিশ রাজ সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ব্রিটিশ ভূখণ্ডে ফরাসী বিপ্লবের কুপ্রভাব ঠেকিয়েছে। ফরাসী বিপ্লবের সমসাময়িক সেই বছরগুলোতে ব্রিটেনেও অনেক ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল কিন্তু ব্রিটিশ রাজ তাদেরকে ভয়ানক নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। তখন নাটক থিয়েটারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার, প্রসার এবং বিকাশের জায়গাগুলোতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ঠিক এ সময়টাতেই ইংরেজি কবিতা তার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌছায়। এত প্রতিভাবান কবিদের একসাথে সমাগম এর আগে দেখা যায়নি। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কোলরিজ, শেলী, বায়রন, কীটস থেকে শুরু করে উইলিয়াম ব্ল্যাক, রবার্ট বার্নস এর মত কবিদের মেলা বসেছিল সে সময়টাতে। রোমান্টিক যুগের সময়কালকে ধরা হয় সাধারণত ১৭৮৫ থেকে ১৮৩০ এ সময়টাকে। ১৭৮৫ সালে স্যার স্যামুয়েল জনসনের মৃত্যুর পর একটা যুগের সমাপ্তি ঘটে এবং নতুন যুগের আগমন ঘটে। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১৭৯৮ থেকে ১৮৩২ পর্যন্ত সময়টাকে রোমান্টিক যুগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এরকম সময় ভাগ করে দেয়ার বিষয়টি আসলে সে যুগের কবিকুল নিজেরা নিজেদেরকে দেয়নি। এর অনেক পরে সাহিত্যসমালোচক ও পণ্ডিতকুল সময়টাকে বুঝতে, ব্যাখ্যা করতে এ নাম দেন এবং সময়কালে ভাগ করে দেন। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর সময়কালের কবি লেখকরা নিজেদেরকে ‘রোমান্টিক’ হিসেবে অভিহিত করতো না। ইংরেজ ঐতিহাসিকরা তাদের সময় থেকে অর্ধ শতাব্দী পর এই অভিধা দেয়। সমসাময়িক সমালোচকরা তাদেরকে একসাথে চিহ্নিত করতো না বরং একেক জনকে আলাদা আলাদাভাবে ধরতো। তবে তাদের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপ, ধারা, স্কুল বা ব্লক ছিল। যেমন ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ ছিলেন ‘দ্য লেক স্কুল’; রবার্ট সাউদি, লেই হান্ট, হাজলিট ও জন কীটসকে ‘দ্য ককনি স্কুল’ এ ফেলানো হতো যা লন্ডনি কবি লেখকদেরকে খুবই নিন্দার্থে ব্যবহার করা হতো। আর বায়রন, শেলী ও তাদের অনুসারীদের ‘দ্য স্যাটানিক স্কুল’ এ ফেলানো হতো।
এ সময়কালটা পুরো ইউরোপের জন্য যেমন উত্তাল ছিল তেমনি ব্রিটেনের জন্যও। কৃষিভিত্তিক সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকে শিল্প ও পুজিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় প্রবেশ করছিল ব্রিটেন। শিল্প বিপ্লব এবং সে সময়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার মানুষের জীবনে অভূতপূর্ব গতি দেয়, বিশাল পরিবর্তন নিয়ে আসে। সেগুলো হচ্ছে জেমস ওয়াটের স্টিম এঞ্জিন, স্টিফেনসনের রেলওয়ে ও আর্করাইটের সুতার কল। এবং ‘শিল্প বিপ্লব’ কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শেষ দুই দশকেই শুরু হয়েছিল ইংল্যান্ডে। তখন পুরনো সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে নতুন ব্যবস্থা গড়ে উঠছিল। এর মধ্যে আমেরিকান বিপ্লবও ইউরোপকে বিশেষ করে ব্রিটেনকে ধাক্কা দিয়েছিল। উল্লেখ্য আমেরিকান বিপ্লব ফরাসী বিপ্লবকেও প্রভাবিত করেছিল।
ফরাসী বিপ্লবের প্রথম দিককার ঘটনাগুলোর মধ্যে বাস্তিল দুর্গের পতন এবং ‘ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস্ অব ম্যান’ ঘোষণা করা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাস্তিল দুর্গের পতন ঘটিয়ে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করার মাধ্যমে যে বিপ্লবের শুরু হয় সেটাকে প্রথম থেকেই সমর্থন দিয়ে আসছিল ব্রিটেনের লিবারেল ও র্যাডিকালরা। সে সময়ের রাজনৈতিক ও সামাজিক তর্কগুলো বুঝতে হলে আমাদেরকে সে সময়ের দুজন প্রভাবশালী লেখক ও রাজনীতিবিদের লেখার দিকে খেয়াল করতে হবে।
ফরাসী বিপ্লবের সমালোচনা করে প্রথম লিখেন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ও চিন্তক এডমান্ড বার্ক। তার ‘রিফ্লেকশনস্ অন দ্য রেভুলূশন ইন ফ্রান্স’ প্রকাশিত হয় ১৭৯০ সালে, একেবারে বিপ্লবের ঠিক এক বছরের মাথাতেই। তার এ লেখার তীব্র সমালোচনা করে থমাস পেইন লিখেন ‘রাইটস্ অব ম্যান’(১৭৯১-৯২)। তিনি এডমান্ড বার্কের সমালোচনা করে ফরাসী বিপ্লবকে মহিমান্বিত করে তুলে ধরেন। ম্যারি ওলস্টোনক্রাফ্টের ‘অ্যা ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটস অব ওম্যান’ (১৭৯২) প্রকাশ একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এটি পরবর্তীতে নারী অধিকার আন্দোলন তথা নারীবাদের মেনিফেস্টো হিসেবে স্বীকৃত হতে থাকে। ঠিক এ সময়টাতে ব্রিটেনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশ পায়। উইলিয়াম গডউইন এর ‘ইনকোয়ারি কনসার্নিং পলিটিক্যাল জাস্টিস’। তার লেখাটি প্রকাশিত হয় ১৭৯৩ সালে। (এর কিছুদিন পর ম্যারি ওলস্টোনক্রাফ্ট ও গডউইন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন এবং তাদের একটি কণ্যাসন্তান হবে যার নাম ম্যারি শ্যালি!) সেখানে এমন একটি সমাজের কল্পনা বা পূর্বাভাস দেওয়া হয় যেখানে সমাজ বিবর্তনের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই এমন একটি স্তরে পৌছবে যেখানে সকল সম্পদ সমভাবে ভাগ করা হবে এবং সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটবে। ওয়ার্ডসওয়ার্থ, শেলী ও অন্যান্য রোমান্টিক কবিদের উপর এ বইটির প্রভাব অনেক।
কিন্তু ফরাসী বিপ্লবের প্রতি সমর্থন উঠে যেতে থাকে যখন ফ্রান্সের সাবেক রাজা-রাণী থেকে শুরু করে রাজপরিবার ও অভিজাতদের অনেককে গিলোটিনে দেওয়ার পর ফ্রান্সে ‘অরাজকতার রাজ’ (রেইন অব টেরর) শুরু হয়।
রোমান্টিক যুগের এপিটাফ যদি আমরা লিখতে চাই তাহলে সে সময়ের সবচেয়ে সেরা সাহিত্য সমালোচক ও গদ্যকারের একজন উইলিয়াম হাজলিট এর ভাষায় বলতে হয়: “…It was a time of promise, a renewal of the world-and of letters.”
এটা ছিল প্রতিশ্রুতির সময়, বিশ্বের নতুনত্বের সময় আর শিক্ষা-দীক্ষার সময়।
ইংরেজি নভেল এবং কলোনিয়ালিজম পিঠাপিঠি বড় হয়েছে, হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে, যৌবন পেয়েছে এবং দাপট দেখিয়েছে। ইউরোপে রেনেসাঁ যখন তার পুরুষদেরকে ঘরের বাইরে বের করে আনছিল, নতুন নতুন ভূখন্ড সন্ধানে বের করে দিচ্ছিল তখন নারীরা কিন্তু অতটা ক্ষমতায়িত হয়নি। তারা সনেটে, কবিতায় নায়িকা হিসেবে পূজিত হলেও ঘরে তাদের দায়িত্ব সংসার ব্যবস্থাপনা পর্যন্তই ছিল। তাদের শিক্ষা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছিল চিঠি লেখা এবং পড়তে পারা পর্যন্ত। শিল্প বিপ্লবের পর আরেকটু বেড়েছে। অষ্টাদশ শতকেও মনে করা হতো নারীর মস্তক কঠিন চিন্তা করার জন্য ফিট নয়। তারা সন্তান প্রজনন এবং পরিবার দেখাশুনা করা নিয়েই ব্যস্ত থাকুক। তাছাড়া অল্প বয়সে বিয়ে এবং তারপর ৫,৬ বা ১০ টি সন্তান গর্ভ ধারণ করা, জন্ম দেয়া, লালন-পালন করা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পার করে দিতো। বুড়ো বয়সে হয়তো খানিক অবসর মিলতো কিন্তু তখন আর কোন সৃষ্টিশীল, সমাজসেবামূলক কাজ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
মোটাদাগে, নারীদের কাজ ছিল ঘর-গৃহস্থালি দেখা, সন্তান পয়দা ও লালনপালন করা। পুরুষরা যতদূর ইচ্ছা লেখাপড়া করতে পারলেও নারীদের শিক্ষা ছিল বড়জোর পড়তে ও লিখতে পারা পর্যন্ত। বিভিন্ন ক্রিশ্চিয়ান কনভেন্টে মেয়েরা বিয়ের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন কেতাবাদি পড়া, ল্যাটিন ও ফরাসী ভাষার মৌলিক পাঠ আর সেলাই কর্মে হাত পাকানোর প্রশিক্ষণ নিতো। এর বাইরে সিরিয়াস পড়াশুনা করা সম্ভব ছিলনা। এই সময়টাতে যেসব নারী একটু বেশি পড়াশুনা করেছেন তাদের বেশিরভাগই বাড়িতে, বাবা ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বিশাল লাইব্রেরিতে। ম্যারি ওলস্টোনক্রাফ্টের পেছনে ছিলেন তার স্বামী উইলিয়াম গডউইন, ম্যারি শ্যালির পেছনে বাবা উইলিয়াম গডউইন, মা ম্যারি ওলস্টোনক্রাফ্ট আর স্বামী পি.বি. শ্যালী। জেন অস্টিন অবিবাহিত ছিলেন এবং বাবার লাইব্রেরিতেই প্রস্তুতি। ব্রন্তি বোনত্রয়ী (শার্লট, এমিলি ও অ্যান ব্রন্তি)ও বাবার বাসাতেই প্রস্তুতি ও বিকাশ। এজন্য বিশ শতকের শক্তিমান লেখিকা ভার্জিনিয়া ওল্ফ তার বিখ্যাত ‘ওমেন এন্ড ফিকশন’ প্রবন্ধে লিখেন- ইংরেজি সাহিত্যের চারজন শ্রেষ্ঠ নারী ঔপন্যাসিক-জেন অস্টিন, এমিলি ব্রন্তি, শার্লট ব্রন্তি ও জর্জ এলিয়ট-এদের কারো কোন সন্তান ছিল না এবং তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন অবিবাহিত!
“And it is significant that of the four great women novelists-Jane Austen, Emily Bronte, Charlotte Bronte and George Eliot-not one had a child, and two were unmarried.” (Women and Fiction, Virginia Woolf)
ভার্জিনিয়া ওল্ফ যেদিকে ইঙ্গিত করেছেন সেটা সহজেই বোধগম্য হওয়ার কথা। রাজপরিবার বা অভিজাত পরিবারের ক্ষুদ্র অংশ ছাড়া অন্যদের আগানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ প্রতিবন্ধকতা ছিল। তো রাজপরিবার বা অভিজাত পরিবারের নারী সদস্যদের অবসর-বিনোদনের মোটামুটি ব্যবস্থা ছিল বিভিন্ন কোর্টে, রাজপ্রাসাদে বা ক্যাসলে।
কিন্তু এর বাইরে বিশাল যে নারী সমাজটি ছিল তাদের কাজ ছিল কি, তাদের বিনোদন ছিল কোথায়? যারা আবার একটু লিখতে পড়তে জানে, যাদের বাবা, স্বামী, প্রেমিক ও ভাই দূরের বিভিন্ন ভূখণ্ডে রাজ দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। তাদের কাছে চিঠি লিখে হাত শান দেওয়া এবং নভেল নামক নতুন ধারাটি পাঠ করে সময় পার করার সুযোগ পায়। এই বিশাল নারী পাঠকশ্রেণীকে পড়ার উপকরণ দেওয়ার তাগিদেই নভেল একটি ফর্ম আকারে সমৃদ্ধ হতে থাকে। এখন যেমন বিভিন্ন সিরিয়ালের প্রধান ভোক্তা নারী তেমনি তখন নভেলের বাজার তৈরিতে এই অলস পাঠক শ্রেনীটি বেশ ভালো ভূমিকা রেখেছে।
ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম নভেল ধরা হয় স্যামুয়েল রিচার্ডসন এর ‘পামেলা’কে। ‘পামেলা’ কেমন আমরা যদি তার দিকে খেয়াল করি দেখবো সেটা আসলে নবীন প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীকে প্রেমপত্র লেখাদির কলা। তার অন্যান্য নভেলগুলোতেও চিঠির আধিক্য আছে। গ্রেট ব্রিটেনের বিশাল সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল পুরুষকুল, তরুণসমাজ। তাদের স্ত্রী বা প্রেমিকাদের বেশিরভাগই ছিল ব্রিটেনে। তখন যোগাযোগের সহজলভ্য মাধ্যম ছিল চিঠি। নারীদের নতুন পাওয়া পড়তে ও লিখতে শেখার চর্চা হতো এই চিঠি লেখালেখির মাধ্যমে। এজন্য স্যামুয়েল রিচার্ডসনের ‘পামেলা’ ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম সার্থক নভেল হতে বাধ্য। ‘পামেলা’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৪০ সালে।
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে গ্রেট ব্রিটেনের বিশাল উপনিবেশ এবং তা থেকে অর্জিত, সংগৃহীত অকল্পনীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ব্রিটেনে একটি বিশাল অলস শ্রেণী তৈরি করে। সেখানে পুরুষদের কাজ ছিল বিভিন্ন ক্যাফেতে যাওয়া, আড্ডা মারা, তর্ক করা আর নারীদের কাজ ছিল কয়েক পলেস্তেরা মেকাপ লাগিয়ে এই সব আড্ডার রওশন বাড়িয়ে দেয়া। তাদের বেশিরভাগের অবস্থা ছিল টিএস এলিয়টের ‘ইন দ্য রুম ওম্যান কাম এন্ড গো টকিং অব মাইকেল এঞ্জেলো’র মতো!
এই অলস পাঠক শ্রেণীটিও নভেলের বিকাশে ভূমিকা রেখেছে বৈকি।
নিয়ন্ত্রত মঞ্চ এবং নভেলের বিকাশ
১৭৫০ এর আগে ‘নভেল’ শব্দটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সাহিত্যের একটি ফর্ম হিসেবে আবির্ভূত হয়েই সেটা জুলিয়াস সিজারের মত সাহিত্যজগতে ‘এলাম, দেখলাম এবং জয় করলাম’ বলে উঠলো।
স্টেজ বা মঞ্চ কয়েক হাজার বছর ধরে একটি গণতান্ত্রিক মাধ্যম এবং সেখান অনেক লোকের সমাগম হয়ে থাকে। এজন্য রাজতন্ত্র এটাকে নিয়ন্ত্রিত রেখেছে বিভিন্ন সময়। আবার ধর্মীয় বিভিন্ন উত্থান-পতনের সময়গুলোতে এর উপর প্রভাব পড়েছে। পিউরিটান পিরিয়ড বা ক্রমওয়েলের ইংল্যান্ডে তো থিয়েটার নিষিদ্ধ ছিল। রেস্ট্রোরেশন পিরিয়ডে থিয়েটার উন্মুক্ত হলো। এর পরবর্তীতে বিভিন্ন শাসনকালে এবং ফরাসী বিপ্লব পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে রাজ বিভিন্নভাবে থিয়েটারের উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করতো।
ব্রিটেন সব সময়ই বিপ্লবকে ভয় পেতো এবং কোন ধরণের বিপ্লব দানা বাধার সুযোগ দেয়া হতো না। এজন্য ফরাসী বিপ্লোবত্তর উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে নাটকের উপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসা হয়। এ সময়কালটাকে পিউরিটান পরবর্তী সবচেয়ে কঠিন সময় ধরা যায় নাটক থিয়েটারের জন্য। থিয়েটার ও নাটক নিয়ন্ত্রণের যে ‘লাইসেন্সিং অ্যাক্ট’ ছিল সেটাও ১৮৪৩ সালে রহিত করা হয়। এটা রহিত করার আগে মাত্র দুটি থিয়েটার নাটক নিয়ে আসতে পারতো। ‘দ্রুরি লেন’ ও ‘কভেন্ট গার্ডেন’ নামে দুটো থিয়েটার বৈধ (লেজিটিমেট) ও কথ্য (স্পৌকেন) ড্রামা আনতে পারতো। আর বাকিরা শুধু গীতিনাট্য (মিউজিক্যাল প্লে) মঞ্চায়ন করতে পারতো। সেখানে নাচ-গান থাকতো, সংলাপ থাকতো না। মঞ্চের এই চাপা সময়টাতেই নভেল একটি ফর্ম আকারে ফুলে ফেপে উঠে।
গথিক নভেল, নভেলের শৈশব:
অষ্টাদশ শতকের শেষভাগটাতে একটি নতুন ঘরানার নভেল আসে। পরবর্তীতে যাকে গথিক নভেল (Gothic Novel) অভিধা দেওয়া হয়। হোরেস ওয়ালপুল, এক প্রধানমন্ত্রীর তনয় ‘ক্যাসল অব অত্রান্তু: অ্যা গথিক স্টোরি’ নামে একটি নভেল লিখেন। ১৭৬৪ সালে প্রকাশিত এই নভেলটি পরবর্তীতে আরও একই ধাচের নভেলকে প্রভাবিত করে, বা অনেক লেখক এ ধাচে লেখা শুরু করেন। একই ধারার আরেকটি গথিক নভেল হচ্ছে ক্লারা রিভ এর ‘দ্য চ্যাম্পিয়ন অব ভার্চ্যু: অ্যা গথিক স্টোরি’ যেটি প্রকাশিত হয় ১৭৭৭ সালে। এ ধারার লেখার কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলোর সেটিং ও কাহিনী মধ্যযুগের কোন পুরনো প্রাসাদকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। রহস্য, খুন, ভয়ংকর কাহিনী, আধিভৌতিক গল্প গথিক নভেলের প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গ। এই ধারার সবচেয়ে সফলদের মধ্যে নারীদের উপস্থিতি বেশি। একটা কারণ হতে পারে সমকালীন নারীদের বদ্ধ জীবন এবং তার প্রকাশের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম ছিল এটি। সহজ ভাষায়, সরাসরি যে কথাগুলো বলা যায়না, পুরুষতান্ত্রিক ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজের যে অসংগতি সরাসরি বলা সম্ভব ছিল না এটা গথিক স্টাইল সম্ভব করে দিয়েছিল। পুরুষের নির্যাতন ও বঞ্চনাকে সরাসরি উপস্থাপন না করে কোন আধিভৌতিক, ভয়ংকর, খুনে চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা খুব কাজের ছিল।
অ্যান র্যাডক্লিফ একজন উল্লেখযোগ্য লেখিকা। ‘দ্য মিস্ট্রিজ অব ওডলফো’(১৭৯৪) এবং ‘দ্য ইতালীয়ান’(১৭৯৭)-এ দুটি নভেলে একজন হোমি ফ্যাটালে বা ভয়ংকর পুরুষ ভিলেন চরিত্রে থাকেন। (একই ধাচের ‘ফেমে ফেটালে’-ভয়ংকর/ধ্বংসাত্মক নারী)
সে সাধারণত খুবই রহস্যজনক ও নিঃসঙ্গ পুরুষ হয়ে থাকে এবং অন্যের উপর নির্যাতন করে থাকে কারণ সে নিজেও অপ্রকাশ্য অপরাধবোধে আক্রান্ত। ভিলেন হওয়ার পরও পাঠকের মনে নায়কের চেয়ে বেশি আগ্রহের স্থান নিয়ে থাকতো। এই গথিক স্টাইলের প্রভাব রোমান্টিক কবিতাতেও প্রভাব ফেলেছে। রোমান্টিক কবিকুলের সর্দারদের একজন কোলরিজ এর ‘ক্রিস্তাবেল’ গথিক উপাদানে সমৃদ্ধ কবিতা। বায়রনের নায়ক-ভিলেন চরিত্রগুলোতে গথিক উপাদান ভালোভাবে পাওয়া যায়। জন কিটসের ‘ইভ অব সেন্ট এগনেস’-এর সেটিং ও বর্ণনামূলক অংশগুলো গথিক ধাঁচের।
এর সিলসিলা অনেক লম্বা সময়ের জন্য ছিল। শার্লট ব্রন্তির ‘জেন আয়ার’-এ ও আমরা এর প্রভাব দেখতে পাবো।
নতুন শতকের (১৯শ) শুরুতে আরেকটি ধাচের নভেল আবির্ভূত হয়। ফরাসী বিপ্লব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নভেলে রাজনৈতিক ও সামাজিক তত্ত্ব নিয়ে আসেন তখনকার লেখকরা। এখানে একটি পরিবারের নাম উল্লেখ না করলে ইউরোপের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল পরিবারের কাহিনী থেকে বঞ্চিত হবো। তাদের সময়কালে ইংল্যান্ডের সবচেয়ে শিক্ষিত ও সৃষ্টিশীল সমাজের অংশ ছিল। গডউইন ও ম্যারি ওলস্টোনক্রাফ্ট দম্পতি তাদের সময়ের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। উইলিয়াম গডউইন একজন রাজনৈতিক দার্শনিক। ১৭৯৪ সালে ‘কালেব উইলিয়ামস্’ (Caleb Williams) নামে একটি নভেল লেখেন যেখানে গল্পাকারে তার রাজনৈতিক মতাদর্শ তুলে ধরেন। তিনি দেখান কিভাবে অভিজাত শ্রেণীর ইচ্ছা, আকাঙ্খার কাছে নিম্ন শ্রেনীর মানুষের জীবন আটকে থাকে। তার স্ত্রী আধুনিক গ্রেট ব্রিটেনের ইতিহাসে আধুনিক চিন্তাভাবনা, শিক্ষাভাবনার অধিকারী হিসেবে স্বীকৃত। তার ‘অ্যা ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটস্ অব ওম্যান’ (১৭৯২) ফেমিনিজমের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী লেখা। তাদের মেয়ে ম্যারি শেলী লিখেন ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’। যা ওই নতুন ধারার নভেলের একটি। রোমান্টিক কবিকুলের বিদ্রোহী পুরুষ পি.বি. শ্যালী ছিলেন তার স্বামী। মা ম্যারি ওলস্টোনক্রাফ্ট যেমন ‘অ্যা ভিনডিকেশন অব দ্য রাইটস্ অব ওম্যান’ লিখে চিন্তা জগতে হইচই ফেলে দেন তেমনি ম্যারি শেলীর ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’ সাহিত্য দুনিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং ক্লাসিকের মর্যাদা লাভ করে।
জেন অস্টিন
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের মিলনস্থলে, ইউরোপে নেপোলিয়নীয় যুদ্ধের উত্তাল সময়ে এক মহিয়সী লেখিকার জন্ম হয় একেবারে অগোচরেই। মাত্র বাইশ বছর বয়সেই ‘প্রাইড এন্ড প্রিজুডিস’ লিখে ফেলেন। কিন্তু তাকে এক যুগ অপেক্ষা করতে হয় নভেলটিকে আলোর মুখ দেখানোর জন্য। মাত্র ৪২ বছরের (১৭৭৫-১৮১৭) ক্ষুদ্র জীবনে ছয়টির মতো নভেল লিখেন যার কয়েকটি ক্লাসিকের মর্যাদা পাচ্ছে। ‘প্রাইড এন্ড প্রিজুডিস’ এর সাথে সাথে ‘এমা’, ‘সেন্স এন্ড সেন্সিবিলিটি’, ‘পার্সুয়েশান’ ও ‘ম্যান্সফিল্ড পার্ক’ ইংরেজি সাহিত্যে অনেক সম্মানজনক জায়গা নিয়ে রেখেছে। খ্রিস্টান পাদ্রীর এই মেয়েটি তার স্বল্প জীবনটার বেশিরভাগ সময়টাই ঘটনাহীন জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন দক্ষিণ ইংল্যান্ডের গ্রাম-শহরগুলোতে বসবাস করে। তার নভেলের থিমগুলোও তার জানাশুনা জগত থেকেই নেয়া। প্রেম, বিয়ে এবং উপযুক্ত পাত্র-পাত্রী খুজে পাওয়া পর্যন্তই। ভার্জিনিয়া ওল্ফ পরবর্তীতে সেটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলবেন একজন মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে যেসব কাহিনীর সূত্রপাত হয় তার বাহিরে যেতে পারেননি জেন অস্টিন। তার সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির উত্তাপ কিভাবে তার লেখনীতে পড়েনি সেটা বিস্ময়ের ব্যাপার বৈকি। তবে তার সীমানায় তিনি সফল হয়েছেন এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সমসাময়িক স্যার ওয়াল্টার স্কট(১৭৭১-১৮৩২) যখন গ্যোতে ও বায়রনের মত আন্তর্জাতিক লেখকের সম্মান পাচ্ছিলেন তখন জেন অস্টিন শুধু একটি সীমিত সংখ্যক পাঠকের দ্বারাই আদৃত হতেন। কিন্তু কালের পরিক্রমায় নভেলের মহারানীর আসনে স্থান পেতে থাকেন জেন অস্টিন। তার ভক্ত বা তার প্রতি সহানুভূতিশীল সমালোচকরা অনেক সময় অতি আবেগে বা অতি ভালোবাসার প্রাচুর্যে তাকে ইংরেজি সাহিত্যের সেরা লেখিকার আসন দিয়ে থাকেন। এটা সাহিত্যের অনেক পণ্ডিত মেনে নেননা, বা তীব্র বাদানুবাদ করেন। তবে তিনি যে শীর্ষ একটি আসন দাবি করতে পারেন এ নিয়ে মতান্তর নেই।
রোমান্টিক যুগ (১৭৯৮-১৮৩২)এ যেমন কবিদের জয়জয়কার ছিল তার পরবর্তী ভিক্টোরীয় যুগটি ছিল নভেলের। সে সময়টাতে চার্লস ডিকেন্স, থ্যাকরে, কার্লাইল, ক্রিস্টিনা রসেটি, রাশকিন, ব্রন্তি বোনত্রয়ী, জর্জ এলিয়ট ও থমাস হার্ডির মতো লেখকদের হাত ধরে ইংরেজি নভেল তার শিখরে পৌছায়।
ভিক্টোরীয় যুগ (১৮৩২-১৯০০)
গ্রেট ব্রিটেনের গ্রেট ইতিহাসে ভিক্টোরীয় যুগ একটি সোনালী অধ্যায় গ্রেট ব্রিটেনের জন্য। wkí-mvwnZ¨, ivRbxwZ, evwYR¨ Ges we‡k^ cÖfv‡ei w`K †_‡K G mgqUv Av‡Mi me hyM‡K Qvwo‡q †M‡Q| ivYx cÖ_g GwjRv‡e‡_i mgq †_‡K hw` weª‡U‡bi DÌvb ïiæ nq wek^kw³ wn‡m‡e Zvn‡j wf‡±vwiqvi mgqKv‡j we‡k^i me‡P‡q cÖfvekvjx †gvo‡j cwiYZ nq weªwUk ivR| ivR‰bwZK cÖfv‡ei mv‡_ mv‡_ ivRbxwZ I `k©‡bi †ÿ‡Î †hgb †Zgwb Dcb¨vm, KweZv I M‡`¨ DrKl©Zvi Zz‡½ D‡V Bs‡iwR mvwnZ¨|
hw`I ivYx wf‡±vwiqv 1837 mv‡j wmsnvm‡b Av‡ivnY K‡ib wKš‘ 1832 mv‡j wf‡±vixq hy‡Mi LywU gvivi KviY n‡”Q 1832 mv‡ji widg© wej Ges ZLb †_‡KB †ivgvw›UK hyM †_‡K mvwnZ¨ GKUv †gvo wbw”Qj| Gi eQi `y‡qK c‡o GKmv‡_ A‡bK¸‡jv eo cÖwZfv gviv wM‡qwQj eQi K‡q‡Ki e¨eav‡b| Gici wKQzw`b g‡b n‡qwQj mvwn‡Z¨ GKUv k~b¨Zv †`Lv w`‡”Q| wf‡±vixq hy‡M †eu‡P _vKv †ivgvw›UK Kwe‡`i g‡a¨ cÖavbZg cyiæl‡`i GKRb DBwjqvg IqvW©mIqv_© Zvi KweZvq †mB nviv‡bv mgq wb‡q Kvu`ybx Ges eZ©gvb‡K wb‡q nZvkvi Pvlevm K‡i‡Qb| IqvW©mIqv_© wb‡q GKUv wRwbm g‡b ivL‡Z n‡e wZwb Zvi †kÖô KxwZ©My‡jv Rxe‡bi cÖ_gv‡a©B wj‡L †d‡jwQ‡jb| Zvi `xN© Rxe‡bi †klv‡a© Avm‡j †Zgb †Kvb KxwZ© †i‡L †h‡Z cv‡ibwb cÖ_gv‡a©i ¯§„wZ †ivgš’b Qvov|
wf‡±vixq hyM‡K eyS‡Z n‡j g‡b ivL‡Z n‡e Gi wKQzw`b Av‡M weª‡U‡b wkí wecøe n‡q‡Q Ges weª‡U‡bi K‡jvwb GZ we¯Í…Z n‡q‡Q †h Ôwekvj weªwUk mv¤ªv‡R¨ KL‡bv m~h© A¯ÍwgZ nq bvÕ| wkí wecø‡ei d‡j h_vixwZ Drcv`b e¨e¯’vq GKUv wecøe ïiæ n‡q wM‡q‡Q Ges Gi cÖfve c‡o‡Q Zvi gvby‡li Dci| cyi‡bv mvgšÍZvwš¿K mgvRe¨e¯’v †f‡½ bZzb ey‡Rv©qv, cyuwRev`x mgvR KvVv‡gvi weKvk n‡”Q| Gi cÖfve Aek¨B c‡o‡Q wkí-mvwnZ¨ I `k©b I ivRbxwZ‡Z|
wf‡±vixq hy‡Mi `ywU ¸iæZ¡c~Y© w`K wQj;
cÖ_gZ, eo †Kvb hy× ev evwni †_‡K SzuwKi †Kvb fq wQj bv (†hgbUv wQj Gi Av‡Mi hyMwU‡Z| we‡kl K‡i †b‡cvwjqb|)
wØZxqZ, cy‡iv mgqUv‡ZB ag©wek^vm we‡klZ wLª÷a‡g©i mgv‡jvPbvq gyLi wQj wPšÍvRMZ|
wek^ cwimi ev evwY‡R¨ eomi DÌvbcZb bv NU‡jI weª‡U‡bi †fZ‡i, mvgvwRK, agx©q cwim‡i e¨vcK IjUcvjU n‡q‡Q GB wf‡±vixq hy‡M| µvBwgqvi hy×UvB GB mgqKv‡ji me‡P‡q eo hy× wQj weª‡U‡bi Rb¨| GQvov fvi‡Zi cÖ_g ¯^vaxbZv msMÖvg †hUv‡K Ôwmcvwn we‡`ªvnÕ bvg w`‡q‡Q †mUv Lye mn‡RB `gb Ki‡Z mÿg nq| 1857 mv‡j fvi‡Zi †mB ¯^vaxbZv msMÖvg e¨_© n‡j cy‡iv fviZel© weª‡U‡bi KiZ‡j P‡j Av‡m| `L‡j P‡j Av‡m A‡÷ªwjqv, KvbvWv Ges Avwd«Kvi eû †`k|
wek^Ry‡o GB wekvj Dcwb‡ek¸‡jv †_‡K m¯Ív a‡i KuvPvgvj msMÖn K‡i eo AvKv‡ii Drcv`‡b P‡j Av‡m weª‡Ub| Avevi †mme Drcvw`Z cY¨ ‡ewk `v‡g wewµi Rb¨ cÖ¯‘Z evRvi wQj K‡jvwb ev Dcwb‡ek¸‡jv‡Z| weª‡U‡bi wKQz wKQz kn‡i M‡o DV‡jv wekvj wkíbMix| g¨v‡Â÷vi, j¨vsKv÷vi, Wvinvg, evwg©snvg, †kwdì, jxWm, wbDKv‡mj, b`ª©vgevij¨vÛ Ab¨Zg| wkí-KviLvbv I Drcv`‡b MwZi mv‡_ mv‡_ gvby‡li †hvMv‡hvM e¨e¯’vq A‡bK MwZ P‡j Av‡m| ‡ijI‡qi g‡Zv AwZKvq ˆ`Z¨vKvi hvb gvby‡li Rxe‡b MwZ wb‡q Av‡m|
h_vixwZ kni¸‡jv‡Z Kv‡Ri mÜv‡b Avmv gvby‡li Pvc evo‡Z jvM‡jv| Avi K‡qK `kK Av‡M †_‡KB MÖv‡gi gvbyl K…wl †_‡K wkí kÖwg‡Ki LvZvq bvg †jLv‡Z ïiæ K‡iwQj| GUv wf‡±vixq hy‡M G‡m Pig mxgvq †cŠQvq| MÖv‡gi K…wlRxwe gvbyl kn‡i G‡m n‡q †Mj kÖwgK-gRyi| †`Lv †Mj 1870 G G‡m Bsj¨v‡Ûi †gvU RbmsL¨vi 70 fvM kÖwgK n‡q †Mj| Ges gvÎ 30 fvM K…wl‡Z i‡q †Mj| Av‡iKUv Z_¨ g‡b ivLvi g‡Zv| 1825 mv‡j hLb weª‡U‡bi †gvU RbmsL¨v wQj cÖvq 13 wgwjqb †mLv‡b ivYx wf‡±vwiqvi g„Zz¨i ci †mUv wZb¸Y n‡q `vwo‡qwQj|
Drcv`‡b Kg©PÂj n‡jv cy‡iv weª‡Ub Ges Gi kni渇jv gvby‡l wMRwMR Ki‡Z jvM‡jv| wekvj †mB kÖwgK‡kÖYxi RvqMv n‡jv kn‡ii Qvqvq ev DcK~‡j Aew¯’Z ew¯Í¸‡jv‡Z| †mme †bvsiv I A¯^v¯’¨Ki ew¯Í‡Z evm KiZ KjKviLvbvi kÖwg‡Kiv| ch©vß Av‡jv evZvmnxb RvqMvq GKmv‡_ 40-50 Rb kÖwgK KvR Ki‡Zv, Nygv‡Zv| Zv‡`i AeY©bxq K‡ói eY©bv Avgiv cv‡ev wf‡±vixq hy‡Mi Jcb¨vwmK‡`i iPbvq, Kwe‡`i KweZvq Ges wPšÍK‡`i †jLvq| Avgiv eZ©gvb evsjv‡`‡ki w`‡K fv‡jv K‡i †Lqvj Ki‡j e¨vcviUv LyeB cwi¯‹vi n‡q hv‡e|
G‡ÿ‡Î g‡b ivL‡Z n‡e wf‡±vixq hy‡MB KwgDwbR, †mvmvwjRg ivR‰bwZK Av`k© wn‡m‡e gv_vPvov w`‡q D‡V| †mB wekvj me©nviv kÖwgK †kÖYxi Dci GKwU ÿz`ª ey‡Rv©qv †kÖYxi †kvl‡Yi weiæ‡× ax‡i ax‡i †R‡M DV‡Z _v‡K weª‡Ubmn cvk^©eZx© BD‡ivcxq †`k¸‡jvi kÖwgK‡kÖYx| 1848 mv‡jB cÖKvwkZ n‡qwQj Kvj© gv·© I G‡½jm Gi weL¨vZ ÔKwgDwb÷ †gwb‡d‡÷vÕ ev ÔKwgDwb÷ cvwU©i Bk‡ZnviÕ| GUv wf‡±vixq hy‡Mi GKwU ¸iæZ¡c~Y¨ Uvwb©s c‡q›U| Av‡iKUv eB †hUv wf‡±vixq hy‡Mi wPšÍv, `k©b, weÁvb I mvwnZ¨ RMZ‡K mg~‡j bvwo‡q †`q †mUv n‡jv Pvj©m WviDB‡bi weL¨vZ Ô`¨ AwiwRb Ae w¯úwmRÕ (1859)| GUv Gi Av‡M ch©šÍ P‡j Avmv mKj ag©fvebv, mgvRwPšÍv I weÁvb‡PZbvi KvVv‡gvi †Mvov‡Z AvNvZ K‡i| Zvi c‡ii Ae¯’vUv nq WweøD we B‡qUm& Gi ‡mB weL¨vZ Dw³i g‡Zv:
Things fall apart, center cannot hold
Mere anarchy is loosed upon the world.
‡Zv `k©b, weÁvb, ag©fvebvq †h IjUcvjU nw”Qj Zvi cÖfve c‡owQj mgvRKvVv‡gv‡Z, wkí fvebvq I mvwnZ¨ixwZ‡Z| GKUv wRwbm jÿYxq wf‡±vixq hy‡Mi Av‡Mi hyM A_v©r †ivgvw›UK hy‡M GKMv`v cÖwZfvai Kwe‡`i mw¤§jb N‡UwQj hvi mv‡_ weª‡U‡bi Avi †Kvb hy‡Mi Avm‡j Zzjbv P‡j bv| wVK GKBfv‡e wf‡±vixq hy‡M weª‡U‡bi †kÖô Jcb¨vwmK I M`¨Kvi‡`i mgv‡ek N‡UwQj hvi mv‡_ Avi †Kvb mgq‡qi Avm‡j Zzjbv nq bv| hw`I G mgqUv‡ZI K‡qKRb †kÖô Kwei AvMgb N‡U wKš‘ G hyMUv‡K we‡kl K‡i Avjv`v Ki‡Z nq Avm‡j Dcb¨vm I M‡`¨i Rb¨|
weª‡U‡bi evRvi cÖmvwiZ nIqvi mv‡_ mv‡_ Zvi ms¯‹…wZ I Zvi fvlvI m¤úªmvwiZ nq| Avi wkíwecø‡evËi weª‡U‡bi cÖKvkbv RMZ I GK eo jvd †`q| me©Rbxb wkÿvi aviYv †jLv-cov Ki‡Z Rvbv gvby‡li msL¨v evwo‡q †`q| GUv wQj Avm‡j cwÎKv, mvgwqKx I Dcb¨v‡mi DÌv‡bi mgq| 1844 mv‡j †UwjMÖv‡di Avwe®‹vi weª‡U‡bi knievmx Z_v cy‡iv BD‡iv‡ci kû‡i‡`i GKUv m¤ú‡K©i eva‡b wb‡q Avm‡jv| GLbKvi mg‡qi B›Uvi‡bU, †dmeyK, ¯‹vB‡c BZ¨vw`i K_v g‡b ivL‡Z cv‡ib| G¸‡jv wKfv‡e Avgv‡`i †hvMv‡hvM e¨e¯’vi Avg~j cwieZ©b wb‡q G‡m‡Q| †ijI‡qi g‡Zv †UwjMÖvd I ‡hvMv‡hvM e¨e¯’vq GKwU gvBjdjK| GwjRv‡e‡_i mg‡q ‡kB·cxqi, gv‡jv© I †eb Rbm‡bi nvZ a‡i †hgb bvUK A‡bK ¸iæZ¡c~Y© f~wgKv cvjb K‡iwQj, wf‡±vixq hy‡M †Zgwb f~wgKvUv †i‡L‡Q Dcb¨vm|
‡lvok, mß`k kZvãx‡Z bvU‡Ki RbwcÖqZv †hgb wQj Zz‡½ †Zgwb Dbwesk kZvãx‡Z Dcb¨vm RbwcÖqZvi kx‡l© †cŠQvq| `k©b, KweZv, weÁvb ev evwYR¨ G me RvqMv‡ZI wf‡±vixq hyM A‡bK Av‡jvwPZ| mvwn‡Z¨i BwZnvm wjL‡Z †M‡j Aek¨ Dcb¨v‡mi DciB †ewk Av‡jv †dj‡Z n‡e| ivYx wf‡±vwiqvi wmsnvm‡b Av‡ivn‡bi mvj A_v©r 1837 mv‡j wW‡K‡Ýi ÔwcKDBK †ccvimÕ †_‡K ïiæ n‡q 1891 G _gvm nvwW©i Ô‡Um Ae w` WziAviwejm&- Gi gvSLv‡b AmsL¨ Dcb¨vm Bs‡iwR mvwn‡Z¨i iIkb evwo‡q †`q|
cÖ_‡g wf‡±vixq hy‡Mi Dcb¨vm I Jcb¨vwmK‡`i wb‡q Av‡jvPbv AvMvB| Jcb¨vwmK‡`i bv‡gi ZvwjKvq cÖ_‡gB Av‡m Pvj©m wW‡K‡Ýi (1812-1870) bvg| LyeB `wi`ª I mvaviY cwiev‡i Rb¥MÖnY K‡i mvwn‡Z¨ gnvb Ae`vb ivLv mvwnwZ¨K‡`i ZvwjKvq †ek m¤§v‡bi mv‡_B P‡j Av‡m Pvj©m wW‡K‡Ýi bvg| RxeÏkvq †jLv‡jwL K‡i cÖPzi A_©, m¤§vb I cwiwPwZ cvIqv †jLK‡`i Ab¨Zg wW‡KÝ| Zvi †jLv‡Z D‡V G‡m‡Q Zvi e¨w³MZ Rxeb-msMªvg, Zvi †e‡o D‡V, Zvi cwi‡ek, Zvi †`k-mgvR I mg‡qi PvjwPÎ| Zvi Pwiθ‡jvI wb‡Ri cwiwPZ RMZ ev Avkcvk †_‡K †bqv| Lye Aí eqm †_‡KB Kg©‡ÿ‡Î †hvM †`qv Ges †jLv‡jwLi RM‡Z cÖ‡ek Ki‡jI Zvi cÖ_g RbwcÖq †jLv n‡”Q ÔwcKDBK †ccvim&Õ| avivevwnKfv‡e GUv cÖKvwkZ n‡q AvmwQj 1836-1837 Gi w`‡K| ÔwcKDBKÕ Gi gva¨‡gB L¨vwZi P~ov‡Z Av‡ivnb ïiæ K‡ib| Gici ïay G‡KKwU gvBjdjK wXOv‡bv| Awjevi UzB÷ (1837), wb‡Kvjvm wbKjwe (1838), w` Iì wKDwiIwmwU mc (1840), †WwfW Kcviwdì (1850-51), weøK nvDm (1852), nvW© UvBgm (1854), G †Uj Ae Uz wmwUR (1859), †MÖU G·‡cK‡Ukbm& (1860) mn cÖvq wekwU Dcb¨vm wj‡Lb|
g‡bviÄb Kiv hw` GKwU wkí nq Zvn‡j Pvj©m wW‡KÝ GKRb AmvaviY wkíx| wZwb gvby‡li nvwm-Kvbœv, `y:L-Kó wb‡q KvjRqx mvwnZ¨ m„wó K‡i‡Qb| me‡ji weiæ‡× `ye©‡ji msMÖv‡gi Rq‡K †`Lv‡Z †P‡q‡Qb Zvi mvwn‡Z¨| wewbg‡q wZwb †h g~j¨evb Dcnvi †c‡q‡Qb Zv n‡”Q gvby‡li fv‡jvevmv| Zvi Dcb¨v‡mi RbwcÖqZv‡K Zzjbv Kiv hvq †kB·cxq‡ii bvU‡Ki RbwcÖqZvi mv‡_| Zviv `yRbB Zv‡`i mgKv‡ji gvbyl‡K fv‡jv ÷vwW K‡i‡Qb Ges Zv‡`i g‡bviÄb Kivi †Póv K‡i‡Qb| Zvi †jLwbi g‡a¨ mgmvgwqK jÛb I Zvi gvbyl I RxebmsMÖvg Ggbfv‡e D‡V G‡m‡Q hvi Kvi‡Y Zv‡K Ôfwel¨Z cÖR‡b¥i Rb¨ we‡kl msev“vZvÕ (like a special correspondent for posterity) wn‡m‡e AwfwnZ K‡iwQ‡jb Zvi mgmvgwqK এক mvsevw`K I cÖeÜKvi।
wf‡±vwiqvb hy‡Mi Av‡iKRb Jcb¨vwmK hvi Rb¥ n‡q‡Q weªwUk fvi‡Zi KjKvZvq wZwb n‡”Qb DBwjqvg †gKwcm _¨vKv‡i (1811-1863)| wPÎwkíx nIqvi †Póv K‡i e¨_© n‡q †mvbv djvb Avm‡j Dcb¨v‡m| Zvi me‡P‡q weL¨vZ I Av‡jvwPZ Dcb¨v‡mi bvg n‡”Q f¨vwbwU †dqvi (1848)|
GKSvK igYxKzj
wf‡±vixq hy‡M jÿYxqfv‡e GKSvK cÖwZfvai bvix Jcb¨vwmK mvwnZ¨RM‡Z †ek mvov †d‡j †`b| Zv‡`i g‡a¨ Kgc‡ÿ Pvi-cvuPRb wek^mvwn‡Z¨i †miv Jcb¨vwmK‡`i ZvwjKvq _v‡Kb| Zviv n‡”Qb-RR© GwjqU, kvj©U eªwšÍ, Gwgwj eªwšÍ, A¨vb eªwšÍ, GwjRv‡e_ Mvm‡Kj, ….
…
w`mivBwj I MøvW‡÷vb:
ivYx wf‡±vwiqvi mg‡q weª‡Ub c„w_exi cÖvq A‡a©K f~LÐ kvmb Ki‡Zv| Avi weª‡U‡bi †fZiKvi ivRbxwZ AvewZ©Z n‡Zv `yRb ¸iæZ¡c~Y© ivRbxwZwe`‡K †K›`ª K‡i| Zviv n‡”Qb MøvW‡÷vb I w`mivBwj| Pig †gavex, eûgyLx cÖwZfvi AwaKvix Ges weªwUk Rb‡Mvôxi Dci ‡ek cÖfvewe¯Ívix e¨w³Z¡ wn‡m‡e `yR‡bB mgvb Av‡jvwPZ e¨w³Z¡ wQ‡jb| w`mivBwj cÖ_g K¨vwiqvi ïiæ K‡iwQ‡jb GKRb Jcb¨vwmK wn‡m‡e Ges ‡jLK I ivRbxwZK wn‡m‡e L¨vwZ AR©b Kiv e¨w³‡`i ZvwjKvq w`mivBwji bvg evieviB P‡j Av‡m|
একজন সিরিয়াস পাঠক হিসেবে বন্ধু লর্ড ম্যাকলে কে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ইংরেজি সাহিত্যের একজন বিখ্যাত ঔপন্যাসিক থ্যাকারে বলেন: “ম্যাকলে একটা বাক্য লেখার জন্য বিশটি বই পড়েন আর শত মাইল ভ্রমণ করে কোন জায়গা নিয়ে এক লাইন বর্ণনা লেখার জন্য।”
“Macaulay reads twenty books to write a sentence and travels one hundred miles to make a line of description” (p525, William J. Long, English Literature-Its History and Its Significance)
উপরোক্ত উক্তিতে হয়তো খানিকটা বন্ধুসুলভ অতিরঞ্জন আছে। কিন্তু বাস্তবতার খুব কাছাকাছি হওয়ারই কথা। বা পাঠক, লেখক, গবেষক, রাজনীতিবিদ ম্যাকলের সিরিয়াসনেস এর কথাই ফুটে উঠে বন্ধু থ্যাকারের কথায়। উইলয়াম ম্যাকপিস থ্যাকারে ‘ভেনিটি ফেয়ার’ উপন্যাস সহ অনেকগুলো উপন্যাস লিখে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে স্বমহিমায় উজ্জল।
ম্যাকলে ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তার খ্যাত বা কুখ্যাত কীর্তি ‘ম্যাকলে মিনিটস’ যেখানে তিনি এক শিক্ষানীতি প্রস্তাব করেন যার মাধ্যমে এই ভারতীয়দের এমন বানানো হবে ‘যারা রক্তে মাংসে হবে ভারতীয়, কিন্তু মাথা-মগজ ও পোশাক-আশাকে হবে ইংরেজ’।
এই ভদ্রলোক ভারতীয় ইতিহাসে এমনভাবে জাড়িত হয়ে আছেন যাকে আপনি পছন্দ না করলেও মুছে দিতে পারছেন না! ম্যাকলে প্রবর্তিত শিক্ষানীতি প্রায় একশো বছর চলে আসছিলো। এর পরেও সেই পাটাতনের উপরই নতুন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এখনো আমাদের শিক্ষানীতি ম্যাকলে থেকে কতটুকু এগিয়েছে সেটা দেখার বিষয়। আজকে শুধু ব্যক্তি ম্যাকলের পাঠক হিসেবে পরিচয়টা নিয়ে থাকলাম। পরবর্তীতে ভালো করে তাকে স্টাডি করার প্রয়োজন বোধ করছি।
লর্ড ম্যাকলে যিনি ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যার প্রবর্তিত শিক্ষানীতিটাকেই আমরা টেনে হিচড়ে লম্বা করার চেষ্টা চালিয়ে আসছি প্রায় দুইশো বছর ধরে। ম্যাকলে আসলে কেমন ছিলেন। খুব ছোটবেলা থেকেই একজন অসাধারণ পাঠক হিসেবে পাওয়া যায় তাকে। ম্যাকলেকে নিয়ে বলা হয়ে থাকে ম্যাকলে অন্যরা যত দ্রুত স্কিম করে তত দ্রুত একটা বই পড়ে ফেলে, আর অন্যরা পৃষ্ঠা উল্টানোর আগেই স্কিম করে ফেলে।
মধ্যবয়সে তিনি লন্ডনের রাস্তায় নিয়মিত হাঁটতে বেড়োতেন। এমনকি লন্ডনের সবচেয়ে জনাকীর্ণ রাস্তাগুলোতেও। এখানেও তাকে নিয়ে প্রচলিত কথা ছিল: ‘তিনি অন্য যে কারো চেয়েই অনেক দ্রুত হাঁটেন, এবং তিনি অন্য যেকোন ব্যক্তির চেয়ে অনেক দ্রুত বই পড়েন।
(As he grew toward maturity he proved unique in his manner, as well as in his power, of reading. It is said that he read books faster than other people skimmed them, and skimmed them as fast as any one else could turn the leaves, this, however, without superficiality. One of the habits of his middle life was to walk through Lond on, even the most crowded parts, ‘as fast as other people walked, and reading a book a great deal faster than anybody else could read.’)
পৃষ্ঠা ১৩৯, অ্যা হিস্ট্রি অব ইংলিশ লিটারেচার, রবার্ট হান্টিংটন ফ্লেচার
১৯২২ সাল
বিংশ শতকের দুটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়। একটি কাব্যদুনিয়ার ম্যাপ পাল্টে দেয় এবং আরেকটি উপন্যাসের দুনিয়া। টিএস এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’ কাব্য এবং জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ এই বছরেই প্রকাশ পায়। সহজে মনে রাখার জন্য এটা মনে রাখতে পারেন, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি এ বছরেই প্রকাশিত হয় এবং তখনকার ভারতে সবচেয়ে বড় তারকার আসনে নজরুলকে বসিয়ে দেয়।
ইউলিসিস সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে জয়েস একটি চিঠিতে একসময় বলেছিলেন:
“I’ve put in so many enigmas and puzzles that it will keep the professors busy for centuries arguing over what I meant, and that’s the only way of ensuring one’s immortality.”
রোমান্টিক যুগের মেনিফেস্টোঃ
১৭৯৮ সালে ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস্’ প্রকাশিত হয়। উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও এস টি কোলরিজ দুজন মিলে লিখেন এই কাব্যগ্রন্থটি। এ সালটিকে বেশিরভাগ সাহিত্য সমালোচক রোমান্টিকতার শুরু হিসেবে ধরে থাকেন। তো ১৭৯৮ সালে ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস্’ এর সাথে একটি ছোট্ট বিজ্ঞাপন(অ্যাডভারটাইজমেন্ট) লিখেছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ। সেখানে ওয়ার্ডসওয়ার্থ পাঠকদের কাছে আহ্বান করেন যেন তারা অধিকাংশ সংখ্যক কবিতাকে পরীক্ষণ বা নিরীক্ষা হিসেবে ধরেন যেখানে তিনি চেষ্টা করেছেন কিভাবে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের মুখের ভাষা কবিতায় নিয়ে আসা যায়।
প্রথম প্রকাশের ঠিক দুই বছর পর অর্থাৎ ১৮০০ সালে এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়। সেখানে ওয়ার্ডসওয়ার্থ তার ছোট্ট বিজ্ঞাপনটিকে একটি নাতিদীর্ঘ ভূমিকাতে (প্রিফেস) পরিণত করেন। ভূমিকার বেশিরভাগ বিষয়াদিই ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতার ভিত্তিতে রচিত। এই ভূমিকাটি আরেকটু আরও সংশোধিত হয়ে তৃতীয় সংস্করণে প্রকাশিত হয়। ১৮০২ সালে প্রকাশিত তৃতীয় সংস্করণে বর্তমানে বহুল প্রচলিত এই ‘প্রিফেস টু লিরিক্যাল ব্যালাডস’ প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর থেকে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অসাধারণ সংযোজন হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে এই ভূমিকাটি। একটি আদর্শ ইংরেজি গদ্যের উৎকৃষ্ট নমুনা এই ভূমিকাটি। এটাকে রোমান্টিক কবিতার মেনিফেস্টো হিসেবে অভিহিত করা হয়।
উনবিংশ শতকের শুরুতে কবিতার ভাষা কি হবে এ নিয়ে জোর বক্তব্য পেশ করেন কবিদ্বয়। এর আগের শতক অর্থাৎ আঠারো শতকে কবিকুল কৃত্রিম, নাটকীয় ভাষায় কবিতা লিখেছেন। ক্লাসিকের অন্ধ অনুকরণ অনেকটা কৃত্রিমতা এবং জীবন বিচ্ছিন্নতা নিয়ে এসেছিল ইংরেজি কবিতায়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ এসে উচ্চারণ করলেন যে একেবারে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষায়ও কবিতা লেখা যায়।
এর আগে কবিতায় জায়গা পেতো শুধু অনেক বড় নায়কেরা, বীর যোদ্ধা, রাজা-রাণীরা আর অভিজাত মহলের বাসিন্দারা। তাদের জীবন, সংঘাত-সংঘর্ষই ছিল কবিতার বিষয়। ওয়ার্ডসওয়ার্থ এসে ঘোষণা করলেন তিনি ‘ইচ্ছে করেই সাধারণ মানুষ এবং তাদের জীবনকে তুলে এনেছেন’ এবং তিনি এমন ভাষা ব্যবহার করেছেন ‘যা ঐসব মানুষ ব্যবহার করে।’ এজন্য আমরা তার কবিতায় দেখবো তিনি তুলে এনেছেন চাষাবুষা, মুটে-মজুর, শিশু, ভবঘুরে, অপরাধী এবং নিচের তলার মানুষদেরকে। তাদের জীবন সংগ্রাম তার কবিতার বিষয়বস্তু হয়েছে এবং তাদের করুণ কাহিনী তার কবিতার সৌন্দর্য হয়েছে।
কবিতার ভাষার ক্ষেত্রে ওয়ার্ডসওয়ার্থ এর একটি বিখ্যাত উক্তি আছে। ‘সকল ভালো কবিতাই হচ্ছে শক্তিশালী/প্রগাঢ় অনুভূতির স্বত:স্ফূর্ত বিচ্ছূরণ’। (…all good poetry is the spontaneous overflow of powerful feeling)
এই আলোচিত মেনিফেস্টো এবং লিরিক্যাল ব্যালাডস শুধু ইংরেজি সাহিত্য নয় বিশ্ব সাহিত্যে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। কারণ এটি একটি বিশাল পালাবদলের নেতৃত্ব দিয়েছিল। কৃত্রিম ভাষা, ছকবাধা ছন্দে কবিতার খোলনলচে একটি নতুন কাব্যভাষা ও কাব্যপ্রকরণ নিয়ে আসে যা পরবর্তীতে মুক্তছন্দে কবিতা লেখার পথকে স্বাগত জানাবে। আর সাধারণ মানুষ যে কবিতার বিষয় হতে পারে এবং তাদের মুখের জবানিও যে কাব্যভাষার গৌরবের ভাগিদার হতে পারে তা একেবারে হাতে ধরিয়ে দেখিয়ে দিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও কোলরিজ তাদের লিরিক্যাল ব্যালাডস এবং তাদের বিখ্যাত ভূমিকায়।
এর বাইরেও ‘প্রিফেস টু লিরিক্যাল ব্যালাডস’ এর আরও যুগান্তকারী ভূমিকা রয়েছে। এটি ইংরেজি সমালোচনা সাহিত্যের জগতে একটি মাইলফলক এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
সহজে মনে রাখুন কিছু মনে রাখার মতো কথা:
Milton’s studies at Horton were deep and wide. One of his notebooks contains pieces taken for eighty writers-Greek, Latin, English, French and Italian. At the same time he was studying music.
There are three divisions in his life:
At Horton: Wrote Shorter Poems
Next: He wrote mainly prose.
Last: Three greatest poems in the last part of his life..
Milton’s prose works were mainly concerned with church affairs, divorce, and freedom…
P-82= Dr. Samuel Johnson was always poor and therefore had to do all kinds of literary work, even if he did not like it.
First of the English dictionaries appeared in 1755 by Johnson..
He was a kind of literary ruler, giving judgements on books and authors like a god.
জনসন মারা যান ১৭৮৪ সালে।
‘Life of Johnson(1791’ by James Boswell is the greatest biography in English.
(“Sir, when a man is tired of London, he is tired of life; for there is in London all that life can afford”)p83 (An Outline of English Literature)
`The Decline and Fall of the Roman Empire’ by Edward Gibbon is recognized as the greatest historical work in English. First book published in 1776, two more books in 1781 and the last three in 1788.
After more than twenty years of search and study, Gibbon says, ‘it was on the day, or rather the night, of the 27th of June, 1787, between the house of eleven and twelve that I wrote the last line of the page in a summer house in my garden.
“1. And it is significant that of the four great women novelists-Jane Austen, Emily Bronte, Charlotte Bronte and George Eliot-not one had a child, and two were unmarried.”
Women and Fiction, Virginia Woolf
কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাল ও ঘটনা:
দোহাই:
১. মডার্ন ফিকশন, ভার্জিনিয়া ওল্ফ
২. অ্যা রুম অব ওয়ান’স ওন, ভার্জিনিয়া ওল্ফ
৩. লিটারেরি থিওরি, অ্যান ইনট্রুডাকশান, টেরি ঈগলটন
৪. নর্টন এনথলজি অব ইংলিশ লিটারেচার, ভলিউম-২, সিক্সথ এডিশন
৫. অ্যা হিস্ট্রি অব ইংলিশ লিটারেচার, রবার্ট হানটিংটন ফ্লেচার
৬. ওম্যান এন্ড ফিকশন, ভার্জিনিয়া ওল্ফ
৭. অ্যান ইংলিশ অ্যানথলজি, নিয়াজ জামান, ফকরুল আলম ও ফিরদাউস আজিম সম্পাদিত
৮. ইংলিশ লিটারেচার, ইটস্ হিস্ট্রি এন্ড ইটস্ সিগনিফিক্যান্স-উইলিয়াম জে. লং
৯. British Literature-Traditions and Change DU Library: Call: 820.7BRI
১০.The Norton Anthology of English Literature-v-01, Call: 820.8NOR
১১.The New Pelican Guide to English Literature- edited by Boris Ford, 8.The Present
১২. English Critical Texts by D.J. Enright, Ernst De Chickera
১৩. The Literature of the Victorian Era by Hugh Walker, Cambridge University Press
১৪. Dictionary of Literary Terms and Literary Theory by J.A. Cuddon, Penguin
১৫. বিশেষ সংখ্যা, শালুক-ফেব্রুয়ারি ২০১১/ আধুনিক সাহিত্যের সর্বাধিক আলোচিত কাব্য ও উপন্যাস
১৬. চিরায়ত পুরাণ-খোন্দকার আশরাফ হোসেন
১৭. An Introduction to Post-Colonial Theory by Peter Childs and Patrick Williams
An Outline of English Literature by Thornley and Roberts, DU Central Library, Call Number: 820.9THO
১৮. Cambridge History of English Literature, DU Central Library, Call Number: 820.9WAC
১৯. কালান্তর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
২০. ইংরাজী সাহিত্যের ইতিহাস, ড: শীতল ঘোষ
২১. এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটানিকা, ভলিউম-১৮
The post লেকচার নোট: ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস appeared first on Bangladesh Study Forum.
ভয়ানক নির্জন একটা ঘরে খুব সুন্দরভাবে একা হয়ে গেলাম। এরকম একটা একাকীত্ম ও নির্জনতাকে অনেক দিন ধরে মিস করতেছিলাম। যে গ্রামের আলো-বাতাস এতদিন ভোগ করলাম, যে গ্রামের মানুষদের অন্ননাশ করেছি সে গ্রামকে নিয়ে, গ্রামের মানুষদেরকে নিয়ে লেখা দরকার।
আমি এখন যে নির্জন কক্ষটিতে আছি সেটা একেবারে জমির মাঝখানে। পূর্বপাশে বিস্তৃত তিরাল্লা বিল (এখন অবশ্য শুকনো মৌসুম চলছে। পূর্ব-উত্তর পাশে, কলেজ থেকে মাত্র এক-দেড়শো ফুট দূরেই গ্রামের গোরস্তানটি যেটি বারবার থমাস গ্রের ‘এলিজি রিটেন ইন কান্ট্রি চার্চইয়ার্ড’ এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এর কয়েকটা লাইন সবসময় মুখে চলে আসে-
“Full many a gem of purest ray serene
The dark unfathomed caves of ocean bear
Full many a flower is born to blush unseen
And losts its sweetness on the desert air.”
আমি যে কক্ষটিতে আছি সেটা দুটো কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে; অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগার ও গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের সদরদপ্তর হিসেবে এবং গ্রামের একমাত্র কলেজ হাজী ইসমাইল খাঁ কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের অফিসঘর হিসেবে।
কলেজের টিনের চালে একটা ঘুঘুকে বসতে থাকতে দেখেছি বিকালবেলা। এর দিকে প্রায় মিনিটখানেক তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি বিনিময় করেছি।আমার তাকিয়ে থাকাতে সেটা বিরক্ত হয়নি তার প্রমাণ ছিল সে ওখান থেকে সড়ে যায়নি। আর একটা নাদুস-নুদোস বেঁজি কিছুক্ষণ পরপর কলেজের আঙ্গিনায় বেড়িয়ে যায়। কলেজের আঙ্গিনাতে বিশটির মতো তুলসি গাছ আছে। আমি নিয়মিত বিরতিতে তুলসি পাতা খেয়ে যাচ্ছি।প্রতিদিন দীর্ঘ সময় হাঁটার পর তুলসি পাতা আমাকে বেশ ফুরফুরে করে রাখছে। তুলসি ছাড়াও প্রায় ৬০-৭০ প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে। সেগুলো খুব দ্রুতই বড় হচ্ছে। গাছের চারা, বিভিন্ন প্রাণীর বাচ্চার বড় হতে দেখা পৃথিবীর সেরা সৌন্দর্যগুলোর একটি!
অর্জুনা গ্রামটি আমার সবচেয়ে পছন্দের গ্রামের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে এর মধ্যেই। গত দেড় বছরে প্রায় তিনবার এসেছি। সামনে থেকে সেটা আরও বাড়বে ও দীর্ঘমেয়াদী হবে বলে মনে করছি! এ গ্রামটি কেন ভালো লাগে তার কয়েকটি কারণ হচ্ছে:
১. গ্রামটি আসলেই দেখতে অনেক সুন্দর, আদিকালের গল্পের গ্রামের মতো। মাত্র তিনমিনিট পশ্চিমে হাঁটলেই চলে আসা যায় যমুনা নদীতে। এত ঘুঘু পাখি একসাথে আমি আর কোথাও দেখিনি। অর্জুনাকে আমার অভিধানে ‘ঘুঘুদের গ্রাম’ নাম দিয়ে রেখেছি। প্র্রতিবেলা ঘর থেকে বের হলেই এক জোড়া বা কয়েক জোড়া ঘুঘু দেখেছি। ঘুঘু আমার প্রিয় একটি পাখি, তার ডাকটা বিভিন্ন কারণে আমার ভালো লাগে। তার ডাকটাকে বাংলাদেশের গ্রামগুলোর আবহমানতার প্রতীক হিসেবে মনে হয়। কোকিলের গান যেমন প্রেমের এবং মধুময় তেমনি ঘুঘুদের ডাক আমার কাছে বিষাদের মনে হয়। পি.বি. শ্যালীর ‘ওড টু স্কাইলার্ক’ কবিতার বিখ্যাত লাইনটি মনে আসছে-
‘মধুর গান সেগুলোই যা আমাদের বিষাদের বিত্তান্ত গায়’ (Our sweetest songs are those tell our saddest thoughts)
ঘুঘুদের সাথে সাথে কোকিলের আধিক্যও রয়েছে। কোকিলের প্রজননকাল চলাতে কোকিল কয়েকটি বিশেষ ধরণে গান গাচ্ছে সেই গান কান পেতে শুনতে বেশ ভালোই লাগে।
দোয়েল, শালিক ও দেখা যাবে বেশ। আরেকটা পাখির ডাক বেশ ভালো লাগবে সেটা হলো হরটিটি। অনেক সুন্দর সে পাখিটা। দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি গায়ও চমৎকার। এই অর্জুনা গ্রামটির একটি বর্ধিত অংশ হচ্ছে চর অর্জুনা। যমুনার এই গজিয়ে উঠা চরটিতে গত পড়শু প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা কাটিয়েছি তাও আবার বিকাল পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। যারা তারা দেখতে ভুলে গেছেন তাদের জন্য খুবই বিস্ময় নিয়ে আসবে এমন চরগুলো। পরিষ্কার আকাশে তারাদেরকে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে মনে হবে। আর সাত্তার ভাইয়ের মতো লোক যদি পাশে থাকে তাহলে কথাই নেই; পথের পাশে অজ্ঞাতে জন্মানো সুন্দর ভাঁটফুল থেকে শুরু করে তারকালোকের সপ্তর্ষীমণ্ডলের সাথেও পরিচিত করিয়ে দেবেন।
চর অর্জুনাতে যদি বিশ-ত্রিশ মিনিট নিরব বসে থাক যায়, আশেপাশের শব্দগুলোর প্রতি মনোযোগ দেয়া যায় তাহলে এক অলৌকিক ও আধিভৌতিক অভিজ্ঞতা নেয়া যায়। আমি যতবারই এসেছি সেটা নিতে ভুল করিনি।
গ্রামটি নিয়ে বিস্তৃত লেখার প্রয়োজন আছে, সেটা আস্তে আস্তে লেখা শুরু করবো।
দ্বিতীয়ত যে কারণে এ গ্রামটি আমার তীর্থস্থানের মতো সেটা হলো এ গ্রাম থেকেই যাত্রা শুরু হয়েছে ‘গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন’। গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের আওতায় আজ রয়েছে ত্রিশ-চল্লিশটির মতো পাঠাগার। এ সংখ্যা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। এর আগে আমাদের পরিচিত সব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শহর থেকে শুরু হতে দেখেছি। এখন সময় এসেছে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পরিবর্তনের ডাক আসার। গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন একটি প্রয়োজনীয়, সময়োপযোগী ও সফল আহ্বান। এর সফলতার আরেকটি দিক হচ্ছে এটি স্বপ্নের একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। অর্জুনার হাজী ইসমাইল খাঁ কলেজে এবছর থেকে ভর্তি শুরু হয়েছে। প্রথম বছর নয়জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে যেটাকে আমি অনেক বড় সংখ্যাই মনে করি। আগামী বছর থেকে এ কলেজটিতে ৫০ বা ১০০ জন ভর্তি হবেন বলে জানা গেছে। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দিয়ে এ কলেজটির স্বপ্নের ব্যাপকতা অনুধাবন করা যাবে না। এটা আগামী এক দশকের মধ্যেই দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় কলেজে পরিণত হবে এ বিষয়ে আমার সন্দেহ নেই। গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন যেমন একটি সফল আহ্বান তেমনি সে আন্দোলনের সন্তান এ কলেজটি একটি ব্যতিক্রমী ও সার্থক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তার স্বতন্ত্র অবস্থান জানান দেবে।
কলেজের জন্য জায়গা-জমিন দিয়ে এগিয়ে এসেছেন গ্রামবাসী। কলেজের দুটি টিনের ঘর বানাতে সাহায্য পাঠিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের শুভাকাঙ্খীরা। একটি কম্পিউটার ল্যাব ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক কম্পিউটার চলে এসেছে যেখানে কলেজের শিক্ষার্থী এবং গ্রামের তরুণরা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আছে কয়েকটি সেলাই মেশিন যার মাধ্যমে গ্রামের নারীরা সেলাই প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
এমন একটি স্বপ্নের হাটে আমার দেওয়ার মতো অর্থ সম্পদ নেই। আমি যেটা দিতে সক্ষম সেটা হলো কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কিছু সময়। গত কয়েকদিন ধরে কলেজ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এক ঘন্টা করে ইংরেজি নামক জটিল ও কঠিন বিষয়টি পড়িয়ে আসছি আর তাদের মনে স্বপ্নের বীজ বপন করার চেষ্টা করছি। জানিনা কতটুকু সফল হবো।
এ লেখাটা শেষ পর্যন্ত যারা পড়বেন তাদের কাছে অনুরোধ তারাও যেন কোন না কোনভাবে এ স্বপ্নের কলেজটি গড়তে নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে এগিয়ে আসেন। কোন কিছু সফল হওয়ার মাঝখানে অনেকেই যুক্ত হতে পারেন কিন্তু কোন একটা বড় স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে প্রথমদিকে যারা ক্ষুদ্র প্রয়াসের হাত বাড়িয়ে দেন তারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কি সেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন? হ্যা! প্রশ্নটা আপনাকেই করেছি!
লেখার স্থান: অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগার, অর্জুনা, টাঙ্গাইল
(মুসাফিরের ডায়রী, মার্চ ৯, ২০১৬
লেখার সময়: রাত ৯ টা থেকে ১০.২০)
The post ‘ঘুঘুদের গ্রাম’ অর্জুনাকে নিয়ে কিছু কথা appeared first on Bangladesh Study Forum.
যমুনা, বিশ্বের প্রধান নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের প্রশস্ততম নদী। হিমালয়ের মানস সরোবর থেকে উৎপন্ন হয়ে হাজার হাজার মাইল চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে কুড়িগ্রামের ভিতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নাম নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে যেখান দিয়ে যমুনা নদী প্রবাহিত হচ্ছে। পূর্বে সেখান দিয়ে প্রবাহিত হতো না। ১৭৮১ সালের রেনেলের মানচিত্র তার সাক্ষ্য বহন করে। ১৭৭৮ সালে এক প্রলয়ঙ্করী বন্যায় ব্রহ্মপুত্র তার গতিপথ পরিবর্তন করে যমুনা নাম নিয়ে বর্তমান ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে।
এই নদীর একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ভাঙ্গনশীলতা। বর্ষায় সে প্রমত্ত হয়ে উঠে। দুই পারের গ্রাম, মাঠ, জমিকে নিয়ে নেয় তার উদরে। ফলে বর্ষার শেষে তার বুকে জেগে উঠে বিশাল বিশাল চর। সেই চরে ঘর তোলে মানুষ। গত বর্ষায় যাদের ঘর ভেঙ্গেছিল। হয়তো আগামী বর্ষায় আবার ভাঙবে। আবার বসতি গড়ে তুলবে নতুন জেগে উঠা কোনো চরে। বর্ষায় যে নদী ফুলে উঠে সমুদ্রের মতো বর্ষার শেষে তাই হয়ে যায় রুক্ষ মরুভূমি। প্রকৃতির বৈরিতার সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় তাদের।
দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠির বাস এই চরে। প্রকৃতির চরম বৈরিতার মধ্যে তারা গতি আনে কৃষিতে। সচল রাখে দেশের অর্থনীতির চাকা। অথচ অচল তাদের জীবনযাত্রা। যাপন করতে হয় তাদের মানবেতর জীবন। বন্যা-খরায় বিপর্যস্ত তাদের জীবন । দেশের মূল জনগোষ্ঠি থেকে তারা রয়ে যাচ্ছে বিচ্ছিন্ন। সরকারের সময় নেই তাদের দিকে নজর দেয়ার। বিভিন্ন সহযোগী উন্নয়ন সংস্থাগুলোর খপ্পরে পরে তারা আরো সর্বস্বান্ত হচ্ছে। খুদ্রঋণের নাম করে রক্ত চুষছে একধরনের এনজিও।
অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের উদ্যোগে গত ১০ বছর ধরে আমরা নৌকা ভাসিয়েছি যমুনায়। রৌমারি থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত বিস্তৃত চরাঞ্চলে আমরা ঘুরেছি। চরের মানুষজনের সাথে মিশেছি, তাদের সাথে খেয়েছি, রাত্রি যাপন করেছি। ফলে একটা অভিজ্ঞতার সঞ্চার হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে আমরা কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছি এবং তার সমাধানকল্পে কিছু প্রস্তাবনা নিচে উপস্থাপন করছি।
সমস্যা
১. কৃষির বৈচিত্র্যহীনতা : ধান, পাট, তিল, কাউন, ভিন্ন অন্য কোনো ফসলের চাষ হয় না বললেই চলে। এই ফসলগুলো তারা চাষ করে কারণ এগুলো চাষ করতে বেশি পুঁজির প্রয়োজন হয় না।
২. পুঁজির স্বল্পতা : রবি শস্য এবং সবজি চাষে ব্যাপক লাভের সম্ভাবনা থাকা স্বত্ত্বেও তারা এগুলো চাষে আগ্রহী হয় না। কারণ পুঁজির স্বল্পতা। এগুলো চাষ করতে প্রথমে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। যা তাদের পক্ষে সংগ্রহ করা অসম্ভব।
৩. যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা : যমুনা নদীর একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো তার ভাঙ্গন প্রবণতা। ফলে সেখানে স্থায়ী কোনো অবকাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব নয়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য তাদের গঞ্জের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। গঞ্জগুলো গড়ে উঠে ৮/৯ কি.মি. দূরে নদীর ওপর পারে মানে বীর এলাকায়। যেখানে নদী ভাঙ্গনের সম্ভাবনা থাকে না। গঞ্জে যাতায়াতের জন্য বর্ষা মৌসুমে একমাত্র মাধ্যম হলো নৌকা আর শুকনো মৌসুমে হাঁটা এবং গুদারা পারাপার ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। যোগাযোগের সহজ কোনো মাধ্যম না থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়েই মূল ভূ-খ- থেকে তারা বিচ্ছিন্ন থেকে যায়।
৪. বাজার সুবিধা না থাকা : যদি কখনো কৃষি বহুমুখী করা যায় বিশেষ করে সবজি চাষ করা যায় তখন একটা বড় সমস্যা হবে তার বাজার পাওয়া। একজন কৃষকের পক্ষে দু’একদিন পরপর সবজি তুলে নিজে গঞ্জে গিয়ে বিক্রি করা একটা অসম্ভব কাজ।
৫. অন্য কোনো পেশার সুযোগ না থাকা : কৃষি ভিন্ন অন্য কোনো পেশার সুযোগ না থাকায় ফসল বোনার পরে কেনো কোনো মৌসুমে বিশেষ করে কার্তিক-আগুন মাসে তাদের বেকার থাকতে হয়। কর্মহীন থাকার ফলে তাদের অভাবে পড়তে হয়। কোনো কোন এলাকায় তা দুর্ভিক্ষের রূপ নয়, স্থানীয় ভাষায় যাকে মঙ্গা নামে ডাকা হয়।
৬. শিক্ষালাভের সুযোগহীনতা : চরে প্রায় ১০ বর্গ কি.মি. জায়গার মধ্যে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও অনেকে শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
৭. প্রশাসনের অনুপস্থিতি : রৌমারি থেকে আরিচা পর্যন্ত এই বিস্তৃর্ণ চরাঞ্চল কড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ জেলার অংশ বিশেষ পড়েছে। দেখা গেছে কোন থানার কিছু অংশ বা একটা বৃহৎ অংশ এই চরাঞ্চলে অবিস্থিত।আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় জেলা শহর নদীর একপাশে উপজেলা পড়েছে নদীর অন্যপাশে। যেমন কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি, রাজিবপুর পড়েছে নদীর পূর্বপাড়ে আর বাকি উপজেলাসহ জেলা সদর পড়েছে নদীর পশ্চিমপাড়ে।ফলে প্রশাসন এই রকম অঞ্চলগুলোতে নজর দিতে পারছে না তাদের সম্পদ ও জনবলের সীমাবদ্ধতার কারণে। এই কারণে হত্যা, খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ সহ নানা অপরাধই হচ্ছে প্রশাসনের নজর এড়িয়ে।
সমাধান
১. কৃষিতে বৈচিত্র্য আনয়ন : প্রচলিত ফসল চাষের পাশাপাশি অপ্রচলিত কিন্তু লাভজনক ফসল চাষে উৎসাহিত করা। যেমন বিভিন্ন রকম সবজি চাষে উৎসাহিত করা।
২. পুঁজি সরবরাহ : অপ্রচলিত ফসল চাষে কৃষককে উৎসাহিত করার জন্য কৃষককে ঋণ সহায়তা দিতে হবে। কিন্তু সেটা হতে হবে বিনা সুদে কিংবা নামমাত্র সুদে এবং দীর্ঘমেয়াদি। ফসল তুলে বিক্রি করার আগ পর্যন্ত তার কাছ থেকে কিস্তির টাকা নেওয়া যাবে না। অর্থ্যৎ কমপক্ষে চার মাস পর থেকে কিস্তির টাকা নেয়া যাবে।
৩. যোগাযোগ সহজিকরণ : যমুনা নদীর বাস্তবতা মাথায় রেখেই চরে কোনো রাস্তাঘাট তৈরি করা যাবে না। খুঁজতে হবে বিকল্প যানবাহন। এক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাব হলো ঘোড়া ও গাধার ব্যবহার জনপ্রিয় করা কিংবা শ্যালো মেশিন চালিত ছোট ছোট লরি।
৪. সমবায় ব্যবস্থা জোরদার করা : দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে কৃষক/কৃষাণী উৎপাদিত ফসল নিয়ে আসবে পাড়ার একটা নির্দিষ্ট বাড়িতে। সব পাড়ার ফসল আবার একটা দল সংগ্রহ করবে। সেগুলো তারা গঞ্জে বিক্রি করার ব্যবস্থা করবে। এই পদ্ধতির একটা বড় দুর্বলতা হলো এখানে মধ্যস্বত্বভোগী দালাল তৈরি হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে।
৫. বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা : চর এলাকায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। যেমন সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার চরাঞ্চলে তাঁতশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। সেখানকার ঘুঠাইল বাজারে টিনের বাঙ্ক তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে জেনারেটরের উপর নির্ভর করে।
৬. দক্ষ জনশক্তি উৎপাদন করা : এলাকার লোকজনের বিদেশ গমনের একটা প্রবণতা আছে। এদেরকে যদি ছয় মাস/এক বছরের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশ পাঠানো যায় তবে একদিকে দেশ যেমন বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে একই সাথে তাদেরও ভাগ্য উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে তারা যেন দালালের খপ্পরে না পড়ে। প্রয়োজনে জনশক্তি এজেন্সিগুলোর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হবে। এবং সহজ কিস্তিতে ঋণদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এই জন্য চর এলাকায় একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। যেটা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে এবং এজেন্সিগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করবে।
৭. চরের প্রতিটি ওয়ার্ডে একটা করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই চরের সমস্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড- পরিচালিত হবে।
৮. প্রশাসনের পুর্নবিন্যাস করণ: আমার মতে রৌমারি থেকে আরিচা পর্যন্ত বিশাল এই চরাঞ্চল নিয়ে একটা বিশেষ জেলা ঘোষণা করা উচিৎ।সহজেই স্থানান্তর করা যায় বা ভাসমান অবকাঠামো নির্মাণ করে সরকারি অর্থের অনেক অপচয় রোধ কারা যায়। নদীর নাব্যতা রক্ষা, শিক্ষা, স্বাথ্য, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ জোর দিবে এই জেলা প্রশাসন। সম্ভব হলে অতিদ্রুত রৌমারি ও রাজিবপুরকে জামলপুরের সাথে আর চৌহালিকে টাঙ্গাইলের সাথে যুক্ত করে প্রশাসনের পুর্নবিন্যাস করলে এই এলাকার মানুষ বিশেষ সুবিধা পাবে। আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে ৭১ সালে আমাদের ১০ নম্বর ছিলো একটি ব্যতিক্রম সেক্টর। ৭১ সালে রণকৌশলের কারণে যদি আমরা সেটা করতে পারি তাহলে এখন কেন সম্ভব হবে না পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠির জন্য স্বতন্ত্র একটা জেলা বা বিভাগ স্থাপন করতে।
এই সমস্ত কার্যক্রম তদারকি করার জন্য গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনকে সংগঠিত করতে হবে। যারা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এলাকায় কাজ করবে। যে কোনো সমস্য সমাধানের চেষ্টা করবে। প্রয়োজনে নানা ধরনের উদ্ভাবনী উপায় তারা আবিষ্কার করবে। যা সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন
The post যমুনার চরগুলোর সমস্যা ও সম্ভাবনা appeared first on Bangladesh Study Forum.
বৃহৎ মঙ্গলের জন্য সমষ্টিকে নিয়ে কোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার নামই আন্দোলন। বাংলার বেশির ভাগ মানুষের বাস গ্রামে। আর এই গ্রামের মানুষেরাই আমাদের উৎপাদক শ্রেণি। কিন্তু আমাদের সমাজে এই উৎপাদক শ্রেণিই আজকে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত ও অবহেলিত। তাদেরকে এই বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি দিতে বাইরে থেকে ধার করে আনা কিংবা চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন মডেলে সম্ভব নয়, সেটি আজ স্পষ্ট। অপর দিকে শহরের মানুষের আত্মকেন্দ্রিকতা, বিলাসিতা, সকলকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা বা পরস্পর বিচ্ছিন্নতা ক্রমেই বাড়ছে। সে কারণে আমাদের সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো কোনো দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হিসেবে আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতা, পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি কারণকে মোটা দাগে চিহ্নিত করতে পারি। যা রোগের মতো আমাদের সমাজে ছড়াচ্ছে, অথচ পরম আদরের সাথে তাকেই আমরা লালন করছি। আত্মবিলাসি এই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে এসে সমষ্টিকে নিয়ে বৃহৎ-এর মাঝে নিজেকে যুক্ত করে সকলের মঙ্গলের জন্যই চাই এক বৃহৎ আন্দোলন। আমরা তার নাম দিতে চাই ‘গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন’।
যেভাবে শুরু
২০০৬ সালে ৭ জন মিলে শুরু করি অর্জুনা অন্বেষা পাঠাগারের কার্যক্রম। পরে যোগ দেন আরো অনেকে। এরই মাঝে বর্ষা মৌসুমে শুরু হয় যমুনার ভাঙ্গন। ঘর বাড়ি ভেঙ্গে অনেক মানুষ যেমন হয় সহায় সম্বলহীন তেমনি অনেক কৃষকের আবাদি জমিও যায় পানির তলায়। তাদের জন্যে কিছু একটা করতে মন চাচ্ছিল । ঢাকার একটা ভ্রমণ দলের (বিটিইএফ) সাথে যোগাযোগ ছিল। তারা কিছু করতে চায় এই অসহায় মানুষগুলোর জন্য। আমাদের এলাকা বন্যা কবলিত বিধায় তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে। প্রথমে তারা চিড়া, গুড়মুড়ি ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করতে চায়। আমরা তাদের বলি আপনাদের উদ্যোগটা মহতী এতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু আমাদের এলাকার এ ধরণের সাহায্য মানুষের কোন উপকারে আসবে না। তার চেয়ে যদি বন্যা পরবর্তী কৃষি পুনর্বাসনে সহায়তা করেন তাহলে গ্রামের মানুষের অনেক উপকারে আসবে। তারা এতে রাজি হন।
পরে আমি আমার নিকট আত্মীয় দুইজনের সাহায্য চাই। তাদের বলি একটা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করে দিতে। তারা একটা তালিকা করে । এতে বেশির ভাগ ছিল একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সদস্যদের নাম। যেটা আমারা আশা করিনি। পরে পাঠাগারের সদস্যরা রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকা করে। এখানে একটা অভিজ্ঞতা হয়, তরুণরা অপেক্ষাকৃত নির্মোহভাবে কাজ করতে পারে।
টাকার পরিমাণ ছিল পঞ্চান্ন হাজার। আমার মত ছিল প্রতি পরিবারকে ১০০০ করে টাকা দিতে। কিন্তু তালিকায় অনেকের নাম থাকায় আমরা সমস্যায় পড়ে যাই। পরে এক সদস্য গবেষনা করে বের করেন আমারা যদি ৫০০ টাকা করে দিই তাহলে ১১০টি পরিবারকে আমরা সহযোগিতা করতে পারবো এবং এ টাকা তাদের কাজেও আসবে। যেমন তখন বাজারদর অনুযায়ী ৩০০ টাকায় ৫ কেজি জালা (ধানের চারা গাছের স্থানীয় নাম) পাওয়া যেত। যা থেকে ৮/১০ মণ ধান পাওয়া যাবে। ৪ সদস্যের একটি পরিবার যা দিয়ে অনায়েসে ১ মাস চালিয়ে নিতে পারবে। বাকি ২০০ টাকা সার ও জমি পরিচর্যার কাজে লাগবে।
আমাদের কঠিন শর্ত ছিল এ টাকা দিয়ে অবশ্যই কৃষি কাজ করতে হবে। পাঠাগারের সদস্যরা এ ব্যাপারে নজরও রাখে। প্রায় ৮০ভাগ লোক এ টাকার সঠিক ব্যবহার করেন আর বাকি ২০ ভাগ লোক আর্থিক অনটনের কারণে ঐ টাকা অন্য খাতে খরচ করে ফেলেন। ফসল উঠার পরে তারা নিজেরাই বলেছিল, তারা গড়ে ১০ মণ করে ধান পেয়েছিল। আর ঐ ধান থেকে যে খড় হয়েছিল তার মূল্যই হবে প্রায় ৫০০ টাকা।
২০০৭ সালে সিডর আঘাত হানে বিস্তীর্ণ দক্ষিণাঞ্চলে। পাঠাগারের পক্ষ থেকে আমরা তাদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিই। সদস্যরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ৩০০০ টাকা ও ৫ মণ চাল উঠায়। কিন্তু বিপদ হয় এগুলো আমারা পাঠাবো কি ভাবে। পরে উপজেলা কর্মকর্তার সাথে কথা বলে সরকারের ত্রাণ তহবিলে জমা দিই। কিন্তু মনে সন্দেহ জাগে এগুলো যথাসময়ে যথাযথ লোকের কাছে পৌঁছবে কিনা?
তখন আমাদের মাথায় আসে যদি ঐ এলাকায় আমাদের পাঠাগারের মতো একটা সংগঠন থাকতো আর তাদের সাথে যদি আমাদের যোগাযোগ থাকতো তাহলে এই সামান্য কটা জিনিসই এই বিপদের দিনে কত না কাজে আসতো। আমাদের এই ভাবনা শেয়ার করি ঢাকার র্যামন পাবলিকেশনের রাজন ভাইয়ের সাথে। ওনি আমাদেরকে আশ্বাস দেন। বলেন যত বই লাগবে নিয়ে যাবেন লজ্জা করবেন না। পরে আমরা লেগে যাই নানা জায়গায় পাঠাগার দেয়ার কাজে। কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চাঁদপুর, নাটোর, বদলগাছি, মধুপুর, সখিপুর, ভূঞাপুরসহ নানা জায়গায় আমাদের প্রচেষ্টায় গড়ে উঠতে থাকে পাঠাগার। বিছিন্নভাবে যে পাঠাগারগুলো গড়ে উঠছে আমরা তাদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকি। খাগড়াছড়ির অরং পাঠাগার এ রকম একটি পাঠাগার। আমারা যুথবদ্ধভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি নাম নিই ‘গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন’।
পাঠাগারগুলো গড়ে উঠে স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে। এলাকার প্রয়োজন, চাহিদা, ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে স্থানীয়রাই সিদ্ধান্ত নেন কী হবে তাদের কর্ম পরিকল্পনা। কেমন হবে তাদের কার্যপদ্ধতি। যেমন জেলা ও থানা পর্যায়ে সাধারণ পাঠাগার থাকায় সেখানে পাঠাগারগুলো হয় বিশেষ ধরনের পাঠাগার। এরকমই একটি পাঠাগার হলো লাইসিয়াম গণিত ও বিজ্ঞান সংঘ। যেখানে আয়োজন করা হয় বিজ্ঞানের নানা সেমিনার, কর্মশালা, ম্যাথ অলিম্পিয়াড, বিজ্ঞানমেলা এমনই নানা ধরনের আয়োজন।
সমস্যা যেমন সমাধানও তেমন
বাংলাদেশ সমতল ভূমির দেশ হলেও সর্বত্র এর ভূমিচিত্র এক নয়। ফলে দেশের এক অঞ্চলের সমস্যা বা সম্ভাবনার সাথে অন্য অঞ্চলের সমস্যা বা সম্ভাবনার রয়েছে বিস্তর তফাৎ। যেমন যমুনার বিস্তীর্ণ চর এলাকার মানুষের যে জীবনযাত্রা, তারা প্রতিনিয়ত যে ধরনের সমস্যা বা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয় এবং এর থেকে উত্তরণে তাদের যে অভিজ্ঞতা তার সাথে কোনো মিল নেই বরেন্দ্র এলাকার মানুষের সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতার সাথে বা তা থেকে উত্তরণ কৌশলের। তেমনি সমুদ্র উপকূলবর্তী দক্ষিণাঞ্চলের সাথে হাওর বা পাহাড়ি এলাকার মানুষেরও সমস্যা বা সম্ভাবনাগুলোও এক নয়। অঞ্চলভেদে দেশের সমস্যাগুলো যেমন ভিন্ন ভিন্ন তেমনি তা থেকে উত্তরণের কৌশলও হতে হবে ভিন্ন ভিন্ন। হাজার হাজার বছর ধরে এ দেশের ভূমিপুত্ররা যেভাবে নিজেদের টিকিয়ে রাখার কৌশল উদ্ভাবন করেছে তার সাথে মেলবন্ধন ঘটাতে হবে আগামীর উন্নয়ন চিন্তাকে। কিন্তু কোনো ক্রমেই চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ অনুপ্রবেশকারী যতটুকু শৃঙ্খলা আনে তারচেয়ে বিশৃঙ্খলতাই তৈরি করে বেশি।
আমরাও দিতে পারি একটি পাঠাগার
অনেকেই প্রশ্ন করেন পাঠাগার দিতে পয়সা লাগে, জমি লাগে – এসব আমরা পাবো কোথায়? হ্যা লাগে কিন্তু তার চেয়েও যেটা বেশি লাগে সেটা হলো ইচ্ছা শক্তি আর আন্ত:রিকতা।একটা পাঠাগার স্থাপনের প্রথম যা দরকার তা হলো সমমনাদের যুথবদ্ধতা। তারপর নিজেদের কাছে যে বইগুলো আছে তা একত্রিত করা।বিদ্যালয় বা করো বাড়ির পড়ার ঘরটাই হতে পারে পাঠাগার।সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য থাকতে হবে একটি কমিটি। বন্ধুরা এইতো হয়ে গেল একটি পাঠাগার। দেখেন এতোটুকু করতে আমাদের কতো টাকা লাগবে।তারপর যদি গ্রামবাসীর কাছে যান একটি করে বই কেনার টাকা (ধরেন ১০০টা)চান, আমার দূড় বিশ্বাস আপনারা ১০০ জনের নিকট দাবি করলে ২০ জন লোক অবশ্যই আপনাদের পাশে দাড়াবে।তারপর ঈদ, পূজা-পার্বনে যখন গ্রামের কর্মজীবীরা গ্রামে আসবে তাদের নিকট গিয়েও যদি অনুরোধ করেন আমার মনে হয় সবাই আপনাদের হতাশ করবে না। মনে রাখবেন পাঠাগার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এখানে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বই সংযোযিত হবে। আর এভাবেই যদি আপনে লেগে থাকেন কয়েক বছর পর দেখবেন আপনাদের দেয়া এই পাঠাগারটিই আলো ছড়াচ্ছে আপনার গ্রামে।
আমরাও পারি এই আন্দোলনে যোগ দিতে
গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের মূল দর্শন হলো সমষ্টির মুক্তির ভিতরেই ব্যক্তির মুক্তি। আপনে যখন আপনার গ্রামের নানা সমস্যা সমাধানের জন্য সমমনাদের নিয়ে একটা পাঠাগার স্থাপন করবেন তখনই যুক্ত হবেন এই আন্দোলনের সাথে। গ্রাম পাঠাগার আন্দোলনের সাথে যুক্ত হতে ধরা বাধা কোন নিয়ম নেই ।গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন যেহেতু একটা চেতনার নাম তাই এর নেই কোন তথাকথিত সাংগঠনিক কমিটি, নেই কোন সংবিধান।কিন্তু বর্তমান প্রযুক্তির সহযোগিতায় আমরা যুক্ত হতে পারি অতি সহজেই। বলতে পারেন ফেইসবুকে গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন নামের যে পেইজ আছে তাই হচ্ছে আমাদের কার্যালয়। এখনেই আমরা যে কোন সময় যে কোন বিষয় নিয়ে করতে পারি মিটিং, করতে পারি আমাদের ভালো কাজের প্রচারণা। বিনে সুতায় আমরা যুক্ত হতে পারি একে অপরের সাথে।দাড়াতে পারি একজন আরেকজনের আপদে –বিপদে।
থাকবে বাধা অনেক
কেউ ভাববেন না আপনে বললেন আর গ্রামের সকলেই রাজি হয়ে যাবে। বরং উল্টোটাও হতে পারে। আপনে সহজেই হতে পারেন তাদের মসকরার লক্ষ্যবস্তু। কেউ কেউ আপনাকে পরামর্শ দিতে পারে – পাবনা থেকে ঘুরে আসতে। সবকিছু অপেক্ষা করে যদি আপনে শুরু করেন তবুও আপনে আপনার পাশে কিছু লোক পাবেন।তখন আপনে হবেন তাদের ইর্ষার বস্তু। নানা ধরণের অপপ্রচার ছড়াবে তারা আপনার বিরুদ্ধে। আপনে বাইরে থেকে কারি কারি টাকা নিয়ে আসছেন, আপনে মেম্বার চেয়ারম্যানে দাড়াবার মতলব করছেন।আপনার পরিকল্পনাকে ভণ্ডুল করবার জন্য স্থানীয় রাজনীতিবীদ ও প্রশাসন পদে পদে আপনাকে বাধার সৃষ্টি করবে। তখন আমাদের একটিই কথা – ‘ যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে’। আরো বাংলায় বললে দাঁতে কামড় দিয়ে পড়ে থাকেন।
আবদুস ছাত্তার খান
সংগঠক, গ্রাম পাঠাগার আন্দোলন
The post প্রতি গ্রামে হোক একটি পাঠাগার appeared first on Bangladesh Study Forum.
The post পুরান ঢাকায় দিনব্যাপী স্টাডি ক্যাম্প করবে স্টাডি ফোরাম appeared first on Bangladesh Study Forum.
You never can tell their position but they are already stalking you. They remain invisible and when the time comes, they strike you with lightning speed with an unerring instinct for hitting the target. The Pakistan occupation army faced such a ghostly force in Chittagong Hill Tracts during the Liberation
War of Bangladesh.
The Tibetan guerrillas, who came from another land to fight for another country’s independence, swept the hills, crushing one Pakistan stronghold after another. “Phantoms of Chittagong,” they are called.
There were several types of operations during the nine-month war but one mission — “Operation Eagle” — was highly exceptional and remarkable as it was under an undeclared, clandestine war plan.
The Bangladesh Liberation Force (BLF) and Indian RAW’s secretive Tibetan team — Special Frontier Force (SFF) — jointly conducted the operation to create a free zone in Chittagong.
Chittagong and Chittagong Hill tracts were considered most suitable zones for guerrilla warfare. Apart from Pakistanis, local Mizo rebels who were helping the occupation forces were needed to be crushed and for this SFF was the best option. Tibetans and Mizos have similar physique.
The Tibetan soldiers believed in rebirth and considered death as a better option towards the lion-gate of future. This thought often made them desperate. Besides, they had keen eyesight and innate capability to sense danger. For any force, they were the best recruits as guerrillas.
They loved modern weapons and disliked getting separated from their weapons, according to some writings.
At the end of the 1962 Indo-Chine war, some documents say, former chief minister of Orissa Biju Patnaik first came up with the idea of a special guerrilla unit comprised of Tibetan youths who had taken shelter in India following Chinese repression in Tibet.
Intelligence Bureau chief Bholanath Mullick took up the initiative and formed SFF, also known as Establishment 22, on November 14, 1962.
In 1971, Indian prime minister Indira Gandhi had played a vital role to bring the force into the Liberation War of Bangladesh.
Writer and researcher Tashi Dhundup of Katmandu, in an article at Himal Southasian, a review magazine of politics and culture, mentioned a letter of Indira to Tibetan force in the writing titled “Not their own Wars”.
“We cannot compel you to fight a war for us,” Gandhi wrote, “but the fact is that General AAK Niazi is treating the people of East Pakistan very badly. India has to do something about it … It would be appreciated if you could help us fight the war for liberating the people of Bangladesh.”
Inspector General of SFF Sujan Singh Uban took up the command of the entire operation.
The preparatory period started from mid-October under the guidance and direct involvement of some Indian Army officers gathered from different regiments, especially from Dehradun Military Academy.
Three columns were formed for the operation — the first one to surround Chittagong through Arakan road in the south, the middle column was to surround Chittagong through Kaptai-Chittagong road and the third to surround Chittagong through Rangamati Chittagong Road.
BLF leader Sheikh Fazlul Haque Moni sent a team to a camp in Agartala Glass Factory. From there, BLF members reached Demagiri border area and met one dozen Indian Army officers and around three thousand SFF members there. (It’s not still clear exactly how many SFF members participated in the war.)
The joint force started its journey from Demagiri on October 11. It had information that the enemy had a strong set up at the bank of the river Karnaphuli. But the troops crossed the border area without any obstacles.
They captured some posts of Pakistan army at Dhanubak, Deghalchhari, Boroitoli and marched towards Barkal. In the second and third week of November, they captured Barkal.
The air force led rocket attacks on Pakistani military’s different establishments to help SFF capture Barkal. After Barkal, they now went for Khagrachhari. The mission was successful but it took the lives of twenty one members of the force.
Within a few days, Shubholong was freed. Next target was Kashalong Khal so that the enemies could not escape though this way to Rangamati. For capturing Kashalong Khal as well as Rangamati, the force sent several soldiers through helicopters.
Due to the shortage of helicopter, the guerrillas were carried in phases. The enemy side assumed that a huge number of troops were gathering there. Panicked, the Pakistan army left most of the areas. Some posts that were under the Pakistan army’s control were finally occupied by the BLF and SFF members after December 10.
The joint force got a message from the Indian army chief to send a strong commando team to Dohajari to block the Arakan road so that the enemies cannot escape to Burma (Myanmar).
The Pakistani army was dumbfounded when they came under attack as they broke the Dohajari bridge so that SFF and BLF members could not cross. In that battle, local freedom fighters joined the BLF and SFF men.
The Pakistan army had to leave the Dohajari area by train on December 12 to Chittagong city. With this, entire Chittagong except for some city areas became free.
After this victory, the force sent a message to the Indian army chief that it was not possible for the enemy to escape to Burma through this way and the Pakistan army had no option but to surrender. So the Indian chief could ask Pakistan army’s eastern command chief Lt Gen AAK Niazi to surrender.
On December 13/14, a portion of the troops reached Anwara upazila and took position at south part of the Karnaphuli river at Marine academy. Meanwhile, BLF members captured the Radio station at Kalurghat.
On December 16, Sector-1 Commander Major Rafiqul Islam’s team along with Indian soldiers occupied the naval base. And in Dhaka, Lieutenant-General AAK Niazi surrendered to Lieutenant General Jagjit Singh Aurora, joint commander of the Bangladesh-India Allied Forces.
On that day, when the Pakistan army surrendered in Dhaka, the Phantoms came out in the open on Chittagong Road to celebrate, Manas Paul wrote in a Time of India article. The locals were stunned by their sudden appearance. Even the Indian soldiers were surprised. They had no clue of their presence in the vicinity. But soon Maj Gen Uban ordered them back into the shadows. And there they remained.
Tibetans lost about 50 men and another 190 were injured in that operation. Later, the Indian government awarded 580 members of the force for their gallantry in the 1971 war.
The post The Tibetan Contribution in 1971-Lecture Note appeared first on Bangladesh Study Forum.
বাংলার হাংরি মুভমেন্ট ওপার বাংলায় যে দোলা দিয়েছিল তার ঢেউ আছড়ে পরেছিল সেই পাশ্চাত্যে আর ল্যাটিনেও। হাংরি মুভমেন্ট এপারেই বরং কম আবেদন কিংবা নাড়া দিয়েছিল বলেই আমার ধারণা। যাই হোক ধারাবাহিক এ রচনার প্রথম কিস্তিতে হাংরি মুভমেন্টকেই আমরা আপন হিসেবে নিয়েছি,যেখানে ইম্প্রেশনিজম পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত ।
প্রেক্ষিত ভিন্ন হলেও এ দুটি ধারা বেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবেই ভাষা,সাহিত্য কিংবা শিল্পকলায় প্রভাব বিস্তার করে গিয়েছে। কিংবা অদ্যাবধি এদের প্রভাব প্রত্যেক করছি বললেও ভুল হবেনা। হাংরি মুভমেন্টকে পাতে তোলার আগে এর ঠিকুজী নির্ণয় যেতে পারে। বাংলা সাহিত্যের অচলায়তন ভাঙতে সুসংগঠিত একমাত্র দার্শনিক নাড়াই ছিল হাংরি আন্দোলন। ১৯৬১ সালের দিকে বিহারে কতিপয় বাঙালী কবির হাত ধরে হাংরি আন্দোলন সূচিত হয়। হালের জনপ্রিয় মলয় রায় চৌধুরী,শক্তি চট্রোপাধ্যায়,সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা সমীর রায় চৌধুরীরা বাংলা সাহিত্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার এক অনুপম দলিল রচনা করেন বিহারের পাটনায়। সেক্ষেত্রে মলয় রায় চৌধুরীকেই মনে করা হয় মুখ্য ভাবগুরু।
প্রচলিত ছন্দ,অলংকার, বানানরীতিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন এঁরা। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে ব্রাত্য শব্দাবলীর অবাধ ছাড়পত্র দিয়েছেন হাংরিয়েলিস্টগণ। ইম্প্রেশনিজম সম্পর্কে লেখা যায় অনেক কিছুই। তবে ইম্পেশনিজম সাহিত্যের আপন কিছু নয়। এটি চিত্রকর্মের আপন মুভমেন্ট। বয়সের দিক থেকে এটি হাংরি মুভমেন্ট থেকে একশো বছরের প্রাচীন। ১৮৬২ সালের দিকে ফরাসী কতিপয় চিত্রশিল্পী নতুনধারার চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেন,যেখানে ক্লোদ মনের চিত্রকর্ম যথেষ্ট আলোচিত ও সমালোচিত হলে একে অনেকে বলতে শুরু করেন “ইম্প্রেসিঁও”। সেই থেকে ইম্প্রেশনিজম জনপ্রিয় হয়। ইম্প্রেশনিজমকে বাংলায় বলা যায় “অন্তর্মুদ্রাবাদ”।
ইম্প্রেশনিজম তাত্ত্বিক দিক থেকে চিত্রকলায় ব্যাপক পরিবর্তনের ইশতেহার রচনা করে। প্রচলিত চিত্রকলায় যেখানে বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন উপলক্ষ নিরৃধারণ করা হয়েছে,সেখানেই ইম্প্রেশনিস্টদের আপত্তি। বাস্তবতাকে বরং রহিত করে বাস্তব বিষয়ের মানসিক অনুরণনকে চিত্রকলার ক্ষেত্রে গুরুত্ববহ বলে মনে করেন ইম্প্রেশনিস্টরা।এভাবে ইম্প্রেশনিজম চিত্রকলা থেকে আলোড়ন তোলে সমস্ত জ্ঞানরাজ্যে।….. (চলবে)
বিঃদ্রঃ পোস্টের বক্তব্যের দায় একান্তই আমার
লেখক : এস এম শাহাদাৎ জামান
The post বাংলার হাংরি মুভমেন্ট ও পাশ্চাত্যের ইম্পেশনিজম : পর্ব ১ appeared first on Bangladesh Study Forum.
ইম্প্রেশনিস্ট ভার্জিনিয়া উলফের লেখা পড়তে গিয়ে বুঝতে পেলাম,কি এক দুঃসাহসিক লেখায় হাত দিয়েছি! পরক্ষণেই ভয়ে সান্ত্বনার প্রলেপ দিয়েছে এই ইম্প্রেশনিজম ও হাংরি মুভমেন্টওয়ালারা। আগের পর্বেই লিখেছি এ দুয়ের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা থাকলেও ইম্প্রেশনিজম সাহিত্যে যে চরিত্রগত পরিবর্তন সাধন করেছে,তাতে বাংলার হাংরি মুভমেন্টের চরিত্রগত মিল আমি পেয়েছি।
হাংরি মুভমেন্টকে আমাদের আপন বলার কারন অবশ্যই আছে। সেক্ষেত্রে বাংলায় দার্শনিক আন্দোলনগুলো দেখুন,কোনটিই এতো আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছে বলে কেউ মনে করেননা। এটি সত্য যে,হাংরি মুভমেন্ট তিন বছরের মাথায় কেঁচে যায় আদালতের খড়গফলে,কিন্তু এর প্রভাব বাংলা সাহিত্যে অদ্যাবধি প্রত্যাঘাত করে চলেছে। প্রচলিত বাংলা সাহিত্যেে রোমান্টিসিজম এক মরুকরণের কাজ করেছে বলেই এঁরা মনে করেন। ভোলা ময়রা,হরু ঠাকুর,কৃষ্ণকান্ত চামার,গেঁজলা গুই যে সত্যি পাতে তোলার মত সাহিত্য রচনা করছেন,এটি হাংরি আন্দোলনকারীরাই প্রথম ঘোষণা করেন। এছাড়া, “সাহিত্য ছেলের হাতের মোয়া নয়” এ জাতীয় আপ্তবাক্যকে ছুঁড়ে ফেলে দেন মলয় রায় চৌধুরীরা।
এখানে আবার বাস্তববাদ চলে আসে অবধারিতভাবেই। মার্কসীয় চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ ঘটেছে এভাবেই। ঠিক সেভাবেই ইম্প্রেশনিস্টগণ প্রথম দিকে “চিত্রকলায়” সাধারণ বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এঁরা কল্পিত কোন দেব মূর্তির বীরত্ব,বিশেষত্ব নিয়ে ব্রাশ ধরেননি,দেবীর খাঁজ,ভাঁজ ইত্যাদি নিয়ে আগ্রহ ছিলনা,এমনকি রাজরাজড়া নিয়েও কিচ্ছুটি আঁকেননি। বরং সাধারণ ক্ষেতমজুর,আপন প্রেমিকা,জলের তাৎক্ষনিক প্রবাহ ছাড়াও আপন পোট্রেট আপনিই করেছেন। আর এখানেই উন্নাসিকদের আপত্তি। শিল্প! সে কি চাট্টিখানি জিনিশ!! এখানে হালকারস!!!! ধৃষ্টতা কেন শিল্প নিয়ে ইম্প্রেশনিস্টদের? হালকা বিষয়গুলো কেন আসবে এখানে? তাও বাতিল করে সব পেন্টিংস,ঠেকাও ওদের প্রদর্শনী। হ্যাঁ,এভাবেই একের পর প্রত্যাখ্যাত হয়েছে নানা প্রদর্শনী। এমনকি সাধারণ সমঝদাররাও এ দলেই ছিলেন। গুরু অস্কার ক্লদ মনে,পিয়েরে অগুস্ত রেনোয়া,বাযিল,আলফ্রেড সিসলের বহু চিত্রকর্ম বাতিল হয়েছে। বাদ যায়নি ভ্যান গগও! আর হাংরিয়ানদের কপালে মামলা জুটেছিল কলকাতায়। “প্রকাণ্ড ইলেকট্রিক সুতার” কবিতাটি নিয়ে যে কান্ড ঘটেছিল,তা কমবেশী সবাই জানি। তবু মলয় রায় চৌধুরী (সদ্যপ্রয়াত), সমীর রায় চৌ ধুরী,সুনীল,শক্তিদের সেই তিন বছরের ঝড়ে বাংলা সাহিত্য ও চিন্তায় লাভ-ক্ষতির গ্রাফ নিয়ে আগামী পর্বে আবার ফিরছি।….. (চলবে)
বিঃদ্রঃ পোস্টের বক্তব্যের দায় একান্তই আমার
লেখক : এস এম শাহাদাৎ জামান
The post বাংলার হাংরি মুভমেন্ট ও পাশ্চাত্যের ইম্পেশনিজম : পর্ব ২ appeared first on Bangladesh Study Forum.
গ্রামের যাকেই কথা বলার জন্য ফোন দেই তাদের মুখ থেকে কথা আর আসে না, আসে শুধু কান্না আর কান্না। বাবা মা ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবার কান্না আর হাহাকারে ভারী হয়ে উঠেছে হাওরের আকাশ বাতাস। এটা এমন এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সর্গচ্যূত কোন দেবতাও যদি তা অবলোকন করতে আসে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না, ঢুকরে কেঁদে উঠবে ক্ষণে ক্ষণে।
কাদঁবেই বা না কেন? তাদের সারা বছরের হাড় খাটুনির সোনালী ফসল, সারা বছর দিন গুজরান করার একমাত্র অবলম্বন যে ভেসে যাচ্ছে অকাল বন্যায়। এক মাসের মধ্যেই সোনালী ফসলে ভরে যেত কৃষকের গোলা। কৃষকের মুখে মুখে থাকতো হাসি আর হাসি। যে ছেলেটি গোলায় নতুন ধান উঠার পর বাবা মার কাছ থেকে নতুন শার্ট উপহার পাওয়ার জন্য প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। বিধাতার কাছে তার এখন দাবি একটাই তারা যেন সারা বছর তিন বেলায় পেট ভরে খাওয়ার মত পর্যাপ্ত ধান গোলায় তুলতে পারে। কিন্তু হায় নিষ্ঠুর প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা যে বড়ই নির্মম। সে কি দরিদ্র কৃষকদের সেই সুযোগটা দিবে?
দিন অতিবাহিত হওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নদীর পানি। বড় বড় বাঁধ ভেঙ্গে গ্রাস করছে কৃষকের সোনালী ফসল। একের পর এক ডুবছে কৃষকের জমির অপরিপক্ব ফসল, বাড়ছে হাহাকার। অবস্থাটা এমন কবির ভাষায় “কাচা ধান কাটিলে হায় কী হইবে, না কাটিলে পানির নিচে তলিয়ে যাবে।” হাওরে ছয় মাস পানি থাকে আর ছয় মাস শুকনো থাকে। পানির মৌসুমে কৃষকেরা কর্মহীন দিন যাপন করে। আর শুকনো মৌসুমে দিন রাত পরিশ্রম করে তাদের একমাত্র ফসল ধান ফলায়। ফসল বলতে ধান ছাড়া অন্যকোন ফসল এখনকার পরিবেশে উপযোগী নয়। তারা আশার প্রহর গুনে কখন বৈশাখ আসবে আর কখন তারা তাদের সোনালী ফসল ধান ঘরে তুলবে। আশায় আশায় পৌষ যায়, মাঘ যায়, ফাল্গুন যায়। আসে বেদনার মাস চৈত্র মাস।
খুব সম্ভবত ইংরেজ কবি ওয়ার্ডস ওর্থ এপ্রিল মাসকে সবচেয়ে নিষ্ঠুর মাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। কিন্তু আমাদের হাওরবাসীর জীবনে সে মাসটি নিঃসন্দেহ চৈত্র। বড়ই অভাবের মাস এটি। কৃষকদের ঘরে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও পকেটে পয়সা না থাকায় হাওরবাসীরা এই মাসে কোন রকম খেয়ে না খেয়ে নিদারুণ অভাবে কাটায়। তাদের ঘরে চাল না থাকায় তিন বেলা না খেয়ে একবেলা খায়, ভাত না খেয়ে মিষ্টি আলু, রুটি খায়। অনেকের কাছে এই কথাগুলো রূপকথার গল্পের মত লাগতে পারে। কিন্তু হাওরে এখনও এটাই বাস্তবতা। এখানকার মানুষ গুলো ছিটমহলবাসীদের চেয়েও বেশি মানবেতর জীবন যাপন করে। ছিটবাসীরা মানবেতর জীবন যাপন করলেও তারা ভাগ্যবান। কর্পোরেট মিডিয়া থেকে শুরু করে দেশের সব মিডিয়াই তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা জনগণ এবং সরকারকে অবহিত করে। কিন্তু এখানকার মানুষগুলো এমনই অভাগা যে কোন মিডিয়াই তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা ঠাঁই পায় না। ফলে ধুকে ধুকে শেষ হয় এখানকার মানুষের এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মের জীবন। এখানের লোকেরাও সরকারকে ভোট দেয়, রাষ্ট্রকে কর দেয়। রাষ্টের প্রতি তারা তাদের যাবতীয় কর্তব্যই পালন করে। বিপরীতে তারা রাষ্ট্র কর্তৃক সামান্যতম অধিকারটুকু পায়। তারা বিদ্যুৎ, মসৃণ যোগাযোগ, শিক্ষা, চিকিৎসক এ রকম আরও অনেক আধুনিক সুযোগ সুবিধা থেকে যোজন যোজন দূরে। সরকারের একটু খানি সুনজরই পারে এই অবহেলিত হাওর বাসীর ভাগ্যের চাকা ঘুরিতে দিতে। হাওরকে মূল্যবান সম্পদে পরিণত করতে ।
লেখক : অনুপম হোসাইন উজ্জ্বল
The post হাওরবাসীর শোকগাথাঁ appeared first on Bangladesh Study Forum.
বাংলাদেশ স্টাডি ফোরামের ৫৯ তম পাবলিক লেকচার:
বাংলাদেশ স্টাডি ফোরামকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ উপস্থিত সকল বন্ধু, ভাইবোন – যারা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছেন। আপনাদের সবাইকে আমার বক্তৃতায় স্বাগত, যে বক্তৃতার শিরোনাম আমি রেখেছি – মুসলিম লিগ(১৯৪৭-১৯৫৪)ঃ জনবিচ্ছিন্নতা এবং পতনের ইতিহাস। ২০১৬ সালের প্রেক্ষিতে বসে, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর কেন আমরা পূর্ববঙ্গের ইতিহাসে মুসলিম লিগের মত একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান এবং পতনের ইতিহাস আলোচনা করবো, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আমি, আপনি, তথা আমরা সকলে যে জায়গাটিতে বসে আছি, তার স্থানিক তাৎপর্য। ডাকসু ভবন এমন একটি জায়গা, যেখানে বাংলাদেশের ইতিহাসের সমস্ত ক্রান্তিলগ্নে কেন্দ্রীয় নেতারা এসে জড় হতেন – ছাত্রনেতারা কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সেটা জানার জন্যে। আমরা জানি, এদেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলনে একদম সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে আমাদের ছাত্র জনগন সম্মিলিত ভাবে। আমরা আজ এই মুহূর্তে বসে আছি, এক কথায় বলা চলে আমাদের দেশগড়ার সূতিকাগারে। আমরা আলোচনা করবো এমন একটি সময়কাল নিয়ে যখন আমাদের শত শত বছরের দাসত্বের বন্ধন থেকে আমরা মাত্র মুক্তি পেয়েছি, দেশভাগ ও স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে আমাদের একটি শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী অতিধীরে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে, তাদের মধ্যে রাজনীতি সচেতনতা তৈরি হচ্ছে, আমাদের বর্তমান যে ডমিন্যান্ট ন্যাশনালিস্ট আইডেন্টিটি – তথা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, তার চেতনা মাত্র তৈরি হচ্ছে এবং পূর্ববঙ্গের জনগণ প্রথমবারের মত অনুভব করছে – দেয়ার ভোট কাউন্টস, অ্যান্ড ইট ক্যান মেইক আ ডিফারেন্স।
ইতিহাস বিজেতাদের রচনা। ডমিন্যান্ট ন্যারেটিভে তাই আমাদের দেশের ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্টগুলো হল – ৫২, ৬৬, ৬৯ হয়ে ৭১। এই ন্যারেটিভের একটু দূরবর্তী অবস্থানে নিজেকে রেখে ইতিহাসের লেন্সে চোখ রেখে যদি আমরা তাকাই তবে দেখবো, এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মোড় আছে। ৫৪ র প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি টার্নিং পয়েন্ট।
একটা রাজনৈতিক দল, যাদের সাক্ষরে পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয় ১৯৪৬ সালে, যে রাজনৈতিক দলটির প্রতি, ঐতিহাসিকরা বলেন – জনগণের দৃষ্টিভঙ্গীতে শুধু শ্রদ্ধা বা কৃতজ্ঞতাই ছিল না, ছিল ভালবাসা এবং অনুরাগের এমন এক মিশ্র আবেগীয় অনুভূতি যা সচরাচর কোন রাজনৈতিক দলের জন্যে দেখা যায় না, কেন সে দলটি মাত্র ৭ বছরের ব্যাবধানে একদম মুখ থুবড়ে পড়বে রাজনীতির ময়দানে? কেন দলটি এদেশের প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ২৩৭টি আসনের মধ্যে মাত্র ১০টি আসন পাবে? এমনকি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও কেন পরাজিত হন অপেক্ষাকৃত অচেনা এক ছাত্রনেতার কাছে?
সামগ্রিকভাবে তিনটি বিষয় মুসলিম লীগের পতন সংক্রান্ত সব ধরনের গবেষণাতেই গুরুত্বের সাথে এসেছে-
এক, ভাষা আন্দোলন(বদরুদ্দিন উমর) ;
দুই, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন(আফজল) এবং
তিন, পাটের দরপতন(পার্ক)।
কিন্তু ডঃ আহমেদ কামাল, যার পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভ এবং তার বর্ধিত এবং পরিমার্জিত সংস্করণ হিসেবে প্রকাশিত বই – ” ষ্টেট অ্যাগেনস্ট দা নেশনঃ দা ডিক্লাইন অফ মুসলিম লীগ ইন প্রি ইনডিপেনড্যান্স বাংলাদেশ” এ প্রাপ্ত তথ্যাবলির ওপর ভিত্তি করে আমার সম্পূর্ণ বক্তৃতাটি দাঁড়া করানো- তিনি বলেন ,এটা মূল কারন নয়, বরং মূল কারন আরও অনেক গভীরে প্রোথিত। মুসলিম লীগ সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের জনগণের আশাআকাঙ্ক্ষা পূরণে যে গড়িমসি করেছে, তার ফল পেয়েছে তারা ‘৫৪র প্রাদেশিক নির্বাচনে। তিনি বলেন – মুসলিম লিগের পতনের ইতিহাস ব্যাখ্যায় সবাই কেন্দ্রে চোখ রাখে, তথা ঐ যে ওপরে উল্লেখিত বিষয়াদি। ডঃ কামাল নাগরিক জীবনের কেন্দ্রে নয় বরং বাংলার রাজনীতির পরিধি, তথা গ্রাম বাংলার কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে মিশে গিয়ে – ‘৫৪র প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লিগের ভরাডুবির সমস্ত কার্যকারণগুলি তুলে ধরেন যার মধ্যে আছে খাদ্য সংস্থান, ভু এবং পানিবণ্টনে ব্যারথতা, আমলাতন্ত্র, জমিদার এবং পুলিশবাহিনীর ঔপনিবেশিক মনোভাব বজায় থাকা এবং পূর্ববঙ্গের নেতাদের রাজনৈতিক সংস্থানে কেন্দ্রীয় মুসলিম লিগের ব্যার্থতা।
যে স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম
১৪ই অগাস্ট ১৯৪৭ সাল মাঝরাত্রে পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করা মাত্রই নবজাতকের শিশুর আগমনকে বরন করে নেয়ার মতই আজান দিয়ে বরন করে নেয়া হয় সদ্যস্বাধীন এই রাষ্ট্রটিকে।
স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে জিন্নাহ বলেন –
“এই মৌলিক নীতির উপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের রাষ্ট্রের সূচনা করছি যে – পাকিস্তান রাষ্ট্রের সকল নাগরিক পরস্পর সমান মর্যাদার অধিকারী… জাতীয় জীবনে চলার পথে আমাদের সর্বদা এটা মনে রাখতে হবে। হিন্দু অথবা মুসলিম কারো প্রধান পরিচয় হবে না। ধর্মের ভিত্তিতে নয়, ব্যাক্তিগত বিশ্বাস অবিশ্বাসের ভিতিতে নয় বরং মানবিকতার সূত্রে আমরা সকলে একত্রে গ্রন্থিত হব, এক কাতারে এসে দাঁড়াবো।”
জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অনেকের মতে স্বাধীনতার সময়টি ছিল “ভারতীয় মুসলমানদের ইতিহাসের সবচেয়ে আনন্দদায়ক মুহূর্ত”, কেউ কেউ আবার একে আখ্যায়িত করেন “পাকিস্তানী বিপ্লব” হিসেবে। নানা লেখা এবং বক্তৃতায় অনেকে এই বিজয়কে উদ্ধৃত করেন ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ব্রিটিশদের কাছে নবাব বাহিনীর পরাজয়ের পর থেকে নিয়ে যতগুলো আন্দোলন হয়েছে – তার সবগুলোর সামষ্টিক বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। কবির ভাষায় পাকিস্তানকে উল্লেখ করা হয় ‘দা ল্যান্ড অফ ইটারনাল ঈদ’ হিসেবে।
তাজউদ্দীন আহমেদ চল্লিশের দশকের শেষদিকে একজন নব্য মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক। তার ডায়রি থেকে আমরা জানতে পারি, ঢাকাকে ঢাকাবাসীরা দিনরাত খেটেখুটে তোরণের পর তোরণ খাটিয়ে- আলোকসজ্জায় ভাসিয়ে দিয়ে একদম ঝলমলে করে সাজায়- স্বাধীনতার আনন্দ উৎযাপনে। রাত্রিতে সরকারি বেসরকারি – সমস্ত দালানকোঠায় আলোকসজ্জার ব্যাবস্থা করা হত, আতসবাজির ঝলকে আলোকিত এবং প্রকম্পিত হত সদ্য প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা লাভ করা ঢাকা শহরের রাতের আকাশ। স্বাধীন দেশপ্রাপ্তির ছুটি উৎযাপনে মানুষের ঢল নামত রাস্তায়, ট্রাকের পীঠে অথবা হাতির পীঠে চেপে তারা রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে স্ফূর্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতো। দিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল হিন্দু মুসলিমের সম্মিলিত মিছিল নিয়ে ভিক্টোরিয়া পার্কে সমবেত হওয়া যেখানে সকল গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নেতারা বক্তৃতা দিতেন।
সদ্যভূমিষ্ঠ রাষ্ট্রটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে আশা ছিল – তারা স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে নিজের জায়গা আবাদ করতে পারবে, জমিদারদের অত্যাচার থাকবে না, পুলিশ পেয়াদাদের দ্বারা গুম-খুন- লুণ্ঠিত – নির্যাতিত হবার ভয় থাকবে না। এখান থেকেই ক্রমশ মোহভঙ্গের সূত্রপাত। কিন্তু তার আগে দেখে আসা যাক যে দলটির হাতে পাকিস্তান চালনের ভার পড়লো, তারা কেমন ছিল।
১৯০৬ সালে জন্ম নেবার পর থেকে মুসলিম লিগের নেতাকর্মীদের মধ্যে খুব একটা কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হয় না। এমনকি ১৯৩৫ সালেও মুসলিম লীগ ছিল একটি ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক দল। জিনকিনসের ভাষ্য মতে ১৯৪০ সালেও তাদের পক্ষে মুসলমানদের জন্যে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন কল্পনাতেও ছিল না।
দল হিসেবে মুসলিম লীগের কখনোই কংগ্রেসের মত জনগন সংশ্লিষ্টতা ছিল না। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী দিনগুলোতে মুসলিম লীগের প্রধানতম চেষ্টাই ছিল ইসলামভিত্তিক জাতীয়তার চেতনায় দক্ষিন এশিয়ার মানুষদের উদ্বুদ্ধ করে পৃথক একটি পরিচয়, পৃথক একটি রাষ্ট্র চাওয়া। মুসলিম লীগ কখনো দল হিসেবে ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার কট্টর সমালোচকও ছিল না, আবার নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের গঠনআঙ্গিক কি হবে এটা নিয়েও তারা বিশেষ কোন আলোকপাত করে নি কখনো।
১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের কোন প্রাদেশিক বা জেলাভিত্তিক শাখা ছিল না। ১৯৪৪ সালের ৯ এপ্রিলে ধাকার ১৫০ মোগলটুলিতে মুসলিম লীগের পূর্ববঙ্গ শাখার উদ্বোধন করা হয়। ঢাকা জেলা মুসলিম লীগ ছিল “নবাব বাড়ি”তে, ঢাকাস্থ নবাব পরিবারের এখতিয়ারভুক্ত। ওতে সাধারণ মানুষের তেমন আসাযাওয়া ছিল না। মেরামতকারীর পরিভাষা ব্যাবহার করলে, ঢাকা জেলা মুসলিম লীগের কাজ ছিল কেবল নিজেদের মধ্যে ষড়যন্ত্র করা, নিজেদের মধ্যে দলাদলি মারামারি ,নিলাম ডাকা এসবই।
লাহোরে ২৩ মার্চ ১৯৪০ সালের সমাবেশে এই পৃথক জাতিস্বত্বার জন্যে পৃথক রাষ্ট্রের দাবি পরিষ্কার ভাবে উত্থাপিত হয়। ১৯৪০ সাল থেকে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা বিপুলাকারে বৃদ্ধি পায়। ১৯৩০ সালেও যে রাজনৈতিক দলটি ছিল মূলত কাগজে কলমেই- ১৯৪৪ সালে এসে সেই রাজনৈতিক দলটির পাঁচ লাখ নিবন্ধিত সদস্য সংখ্যার বড়াই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে সবাইকে। বেঙ্গল মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেনের মতে ১৯৪৬ সাল নাগাদ মুসলিম লীগের সদস্য সংখ্যা দশলাখ অতিক্রম করে। যদিও উক্ত রাজনৈতিক দলের ক্রমবর্ধমান সদস্য সংখ্যা দলটির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বা সদস্যদের মধ্যে শক্তিশালী গণসংযোগ নির্দেশ করে না। ওটা ছিল শুধুই তাদের পূর্ব পাকিস্তানের আমজনতার মাঝে জনপ্রিয়তা পরিমাপের একটি মাপকাঠি মাত্র।
১৯৪৬ সালের ভোটে মুসলিম লীগ তাদের কথার সত্যতা প্রমাণ করলো। প্রমাণ করলো যে মুসলিম লীগই ভারতীয় মুসলমানদের মুখপাত্র রাজনৈতিক দল। বিশেষ করে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের মধ্যে তাদের সমর্থনের কোন অভাব ছিল না। ঐ নির্বাচনে তারা মুসলমানদের জন্যে পৃথকভাবে সংরক্ষিত ১২১টি সিটের মধ্যে ১১৩টি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে।
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর মৃত্যু হলে দলের অভ্যন্তরের এমন কিছু শক্তি আত্মপ্রকাশ করে যা দলের ভাবমূর্তি এবং কার্যকারিতা বিনষ্ট করে, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে। জিরিং এর ভাষ্য মতে – সে ছিল এক রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রের মত পরিস্থিতি। পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থাতেই এর তিনটি ধারা তৈরি হয়ে যায় – এক, ঢাকাস্থ নাজিমুদ্দিনের ধারা; দুই, আবুল কাশেম ফজলুল হকের ধারা; তিন, হোসেইন শহিদ সোহরাওয়ার্দির ধারা। ঢাকার গ্রুপটি ছিল রক্ষণশীল ধারা যাদের প্রধান চিন্তা ছিল জমিদার এবং জমির মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষা। সোহরাওয়ার্দির দলটি ছিল আধুনিক মনস্ক। তারা স্বাধীনতাউত্তর পূর্ববঙ্গের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে দলের সাম্প্রদায়িক চেতনাকে পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। ফজলুল হক ছিলেন গ্রামীণ রাজনীতিবিদ। তার ধারার সাথে সংযুক্ত ছিল নানা পেশার পেশাজীবী মানুষ। এছাড়াও ছিল মাওলানা ভাসানির নেতৃত্বে আসাম মুসলিম লীগ। পূর্ববঙ্গের প্যাঁচঘোঁচের ধারাবিভক্তির রাজনীতিতে আরও জটিলতা সৃষ্টি করতে তার রাজনৈতিক ধারার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। দেশভাগের পর কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের স্নেহপুষ্ট হয়ে নাজিমুদ্দিনের ধারার মুসলিম লীগ পূর্ববঙ্গের ক্ষমতায় বসে।
ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সনে মুসলিম লীগের করাচী কাউন্সিলে গৃহীত অনেক সিদ্ধান্তই সাধারণ মানুষের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট হবার সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ করে দেয়া হয়।
মুসলিম লীগের সমস্ত কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল ছিল তিনটি – এক, মুসলিম লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদানের কেন্দ্র আহসান মঞ্জিল; দুই, মুসলিম লীগের সমস্ত কার্যক্রম প্রচার ও প্রসারের দায়িত্বে থাকা দৈনিক আজাদ পত্রিকাটি এবং তিন, মুসলিম লীগের অর্থনৈতিক ভিত্তি ইস্পাহানী পরিবারের বাড়ি। খুব সংক্ষেপে চিত্রিত করতে গেলে এই হবে উত্তর উপনিবেশিক পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পাওয়ার প্রাথমিক দিনগুলোতে মুসলিম লীগের চেহারা।
কি অবস্থায় পূর্ববঙ্গের মুসলিম লীগ দেশটিকে পায়?
এ বছরের গোড়াতেই, তথা ৪ জানুয়ারি সমস্ত দেশে একটি বৃহৎমাত্রার ভুকম্পনের মাধ্যমে নূতন বছরের যাত্রা শুরু হয়। মুসলিম লিগের শাসনামলের শুরুর সময়টা ছিল অনেকটাই সেরকম।
১৫ই অগাস্ট ২০১৪ থেকে যাত্রা শুরু করা নূতন রাষ্ট্রটিতে চারকোটি বিশলক্ষ জনগণের ২.৯৪ কোটি মুসলিম, ১.১৭ কোটি হিন্দু, প্রায় ৫৭ হাজার খৃষ্টান এবং ১১৭৯ জন শিখ জনগোষ্ঠী ছিল।প্রতি বর্গ মাইলে ৭৭৫জন মানুষের বসবাস, পৃথিবীর সবচাইতে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর একটি মাত্র ৫০০মাইলের সড়কপথ, এবং এঁকেবেঁকে বয়ে চলা অগণিত নদীনালা খালবিলের ওপর ভিত্তি করেই পুনর্গঠন করতে হয় এই রাজ্যের শিল্প ও ব্যাবসাবাণিজ্য।
ভারতের ৪০০টি তুলা কারখানার মধ্যে মাত্র ১০টি ছিল পূর্ব বাংলায়। বঙ্গপ্রদেশের ১০৬টি পাটের কারখানা মাত্র একটি ছিল এ অঞ্চলে।ছিল না কোন লোহা-ইস্পাত-কাগজ-রাসায়নিক দ্রব্যাদির কারখানা, অথবা কয়লার খনি। মাত্র ৪৯টি মৌসুমি পাটকল (তাও ২০ শতাংশ কার্যকরী), ৫৮টি সংক্ষিপ্ত ধানের মিল, চারটি চিনিকল, ছয়টি টেক্সটাইল মিল এবং একটি সিমেন্টের ফ্যাক্টরি নিয়ে এই প্রদেশের বানিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদন এবং ব্যাবসায়িক লেনদেনের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়।
রাষ্ট্র পরিচালনা কার্জের শুরুর দিনগুলো সরকারী নথিতে অধিভুক্ত আছে- “সমস্যা সংকুল সময়” হিসেবে। নূতন শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় আসীন হবার মাত্র পক্ষকাল পূর্বে চিটাগং এবং নোয়াখালীর উপর দিয়ে বয়ে যায় বিধ্বংসী বন্যা, যাতে আক্রান্ত হয় ৫০০ বর্গ মাইলের এলাকার অভ্যন্তরীণ প্রায় দশলক্ষ মানুষ। হাজার হাজার ঘরবাড়ি একদম বিধ্বস্ত হয়, গৃহপালিত পশুপাখি বানের তোড়ে ভেসে যায়, ফসল ধ্বংস হয়। বন্যার রেশ কমতে না কমতেই পূর্ব বাংলার দক্ষিণ উপকূল জুড়ে কক্সবাজার এলাকায় বয়ে যায় প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন, যাতে আক্রান্ত হয় একলক্ষ মানুষের জীবন।
কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা ভারতের সমস্যা সংকুল প্রদেশ গুলির উদাহরণ দিতে তুলনা টেনে আনে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে- আমাদের কিছু কিছু প্রদেশ তাদের যাত্রা শুরু করেছে – পূর্ব পাকিস্তানের মত দেউলিয়া এবং প্রশাসনিক কাঠামো ছাড়াই।
খাদ্য – ও দুর্ভিক্ষের রাজনীতি
মুসলিম লীগের পতনের পিছে প্রধান যে কয়টি কারন ডঃ কামাল উল্লেখ করেন, তার প্রথমটি মুসলিম লীগের খাদ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যারথতা এবং দুর্ভিক্ষের অবস্থা আনায়ন। ধরুন আপনি সাংঘাতিক ক্ষুধার্ত। না খেয়ে আছেন দিনকয়েক। আমার দায়িত্ব আপনার খাদ্যের সংস্থান করার। আপনি আমার কাছে যতবারই আমি আপনাকে ক্ষুধার প্রকারভেদ বোঝাচ্ছি। বলছি – খালি পেটের ক্ষুধার কথা চিন্তা করলে হবে? শারীরিক ক্ষুধার পাশাপাশি আছে মানসিক ক্ষুধা, আত্মিক ক্ষুধা, এগুলোরও তো দেখভাল করতে হবে নাকি? আপনি স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবেন ব্যাপারটা?
একজন মুসলিম লীগের সদস্যই সংসদে দাঁড়িয়ে মন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন যে তিনি যে দেশের দুর্ভিক্ষের কথা স্বীকার করতে চান না – এর কারণ কি এটা যে দুর্ভিক্ষের ঘোষণা দেয়া মাত্রই সরকারের তরফ থেকে ত্রাণ সরবরাহ করা আরম্ভ করতে হবে , যেটা তার পক্ষে সম্ভব না? জবাবে মন্ত্রী আবার সেই শব্দের অর্থগত তাৎপর্য তুলে ধরে বলেন – দুর্ভিক্ষ শব্দটির বেশ কিছু অর্থ আছে। প্রথম পর্যায়ে সেটা খাদ্য সরবরাহ নিয়ে একটি অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি, দ্বিতীয় পর্যায়টি হল খাদ্যের অভাব, আর তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে সেটাকে আক্ষরিক অর্থে দুর্ভিক্ষ বলা চলে। এর চেয়ে বড় নির্মম রসিকতা আর কি হতে পারে?
মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে ৫৪র নির্বাচনী ইশতেহারে যুক্তফ্রন্ট প্রচার করে কৃত্তিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির অভিযোগ। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামলে, অর্থাৎ ১৯৪৩ সনের দুর্ভিক্ষ জনজীবনে এমন নাড়া দিয়ে গিয়েছিল যে, মুসলিম লীগ সরকার সরাসরি দমনপিরন চালাত যে দুর্ভিক্ষের নাম মুখে আনত তাদের ওপর। সমস্ত পত্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল খাদ্যের অভাব সংশ্লিষ্ট কোন খবর প্রচার করার ব্যাপারে। ১৯৪৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর আত্রাই অঞ্চলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী মফিজুদ্দিন আহমেদ বলেন – “যারা এ কথা বলে যে এ দেশে বর্তমানে ১৯৪৩ সালের মত খাদ্য সংকট বিরাজ করছে তারা এ জাতির নৈতিক দিককে আহত করতে চায়। তারা এই রাষ্ট্রের শত্রু।”
১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা, ফরিদপুর, খুলনা, ময়মনসিং, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চিটাগং এবং সিলেট জেলায় খাদ্যশস্যের ব্যাপক অভাব পরিলক্ষিত হয়। ৪৭ সালের শেষ দিকে, সরকারী তহবিলে নূতন খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত মৌজুদ জমা পড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ‘৪৮এর মাঝামাঝিতে এসে আবার তার দাম বাড়তে থাকে।
সরকার এবার নূতন পন্থা চালু করে। সরকারের তরফ থেকে নূতন করে জানানো হয় বড় কৃষক যারা, যাদের ফসলের চাষ এবং উৎপাদন অনেক বেশী – তাদের বাধ্যতামূলকভাবে একটি সরকারী ট্যাক্সের আওতায় আনা হবে। “দা ইস্টবেঙ্গল লেভি অফ ফুড গ্রেইনস অর্ডার ১৯৪৮” নামে প্রস্তাবিত এই আইন ঢাকা গেজেটের বিশেষ সংখ্যায় (১৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮) প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয় রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর, রংপুর, ময়মনসিং (কিশোরগঞ্জ এবং টাঙ্গাইল ছাড়া), সিলেট, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া এবং বাকেরগঞ্জ (বর্তমান বরিশাল) – এই সমস্ত উদ্বৃত্ত ফসলের অঞ্চলকে এই আইনের আওতায় আনা হবে। খাদ্যশস্যের অভাবে ভুগতে থাকা অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ফরিদপুর, পাবনা, চিটাগং, নোয়াখালী, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং বর্তমান কুমিল্লা অঞ্চলকে।
সরকারী ঘোষণার অধীনে সমস্ত অবস্থাসম্পন্ন কৃষক ও ফসল উৎপাদনকারীদের (অবস্থাসম্পন্ন কৃষক হিসেবে এমনসব কৃষক পরিবারকে চিহ্নিত করা হয়, যারা ১০ একর বা তারও অধিক জমিতে পরিবারের সদস্য বা দিনমজুর ভাড়া করে জমিতে ধান বা অন্যকোন ফসল চাষ করাতো) তাদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দিতে বলা হয় উক্ত ট্যাক্স। যে ভাষা সরকারী ঘোষণাপত্রে ব্যাবহার করা হয়, তা ছিল খুবই স্বৈরতান্ত্রিক। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার বদলে সরকার থেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলে এই ঘোষণা।
এছাড়াও কর সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সীমা ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করা হয় যে – অধিকাংশ ফর্ম দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মনগড়া তথ্য দিয়ে নিজেরাই পূরণ করে খাজনা ধার্য করে, ফলশ্রুতিতে দেখা যায় অনেক মৃতব্যাক্তির নামেও খাজনা প্রদানের দায়ভার পড়েছে। এক অঞ্চলে থাকে, অথচ অন্য জায়গায় ফসল চাষ করেছে – এমন চাষিদের ভাগে দ্বিগুণ খাজনা পড়ে। যেসব অঞ্চলে খাজনা আদায়ের খসড়া তালিকা তৈরি হয়, সেসব তালিকা ছিল ভুলে ভরা। অন্যান্য অনেক ইউনিয়নে খাজনা জমা দেবার দিন শুরু হবার আগে ঠিকমত খাজনা দেবে যারা তাদের তালিকাও ঠিকমত প্রস্তুত করে শেষ করা হয় নি। ফলস্বরূপ- খাজনা দেবার সময় শুরু হলেও অতি সামান্য কয়েকজনই ঠিকঠাকমত খাজনা আদায় করে শেষ করতে পারে। আর যারা তালিকার মধ্যে সমস্যা থাকার কারণে সময়মত সরকারী কোষাগারে খাজনা জমা দিতে পারে নি – তারা যে কোর্টে অভিযোগ দাখিল করবে সময়ের স্বল্পতায় তাও সম্ভব হয় নি। যারা অভিযোগ দাখিল করার সুযোগ পান, তাদের কেস কোন রকম তদন্ত ছাড়াই মুলতুবী রাখা হয়।
উৎকোচ দিলে খাজনা মাফের অভিযোগ ওঠে। যশোর জেলার নড়াইলের একটি ইউনিয়নের খতিয়ান পাওয়া যায় যেখানে উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদনকারী সকল কৃষক মিলে খাজনা আদায়কারি অফিসারকে ৫০০ রুপি ঘুষ দিলে পরে সে বছর সে ইউনিয়নের কেউই উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদন করেনি, তাই কাউকেই সরকারের কাছে ধান বিক্রি করা লাগবে না – এমনটা বলে ঘোষণা দেয়া হয়।
যে ভাষায় সংসদে তারা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এ সকল সরকারী কর্মকর্তার পক্ষে সাফাই প্রদান করে, তা ছিল খুবই মজাদার। একজন সাংসদ অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে বলেন যে তাদের “পুত্রসম” – দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তারা কোনভাবেই খাজনা নিয়ে দুর্নীতি করতে পারে না! এমনকি মন্ত্রী নিজেও এই অভিযোগকে নিতান্ত মামুলি একটা ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, যে সমস্ত অফিসারদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছে তারা তার পুত্র, আত্মীয়, প্রতিবেশীর মত।
স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে নিয়ে ১৯৪৯ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত সর্বমোট ৪২ জন সিভিল সাপ্লাই অফিসারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, তার মধ্যে ২৭ জনকে উক্ত ডিপার্টমেন্ট থেকেই সাজা দেয়া হয়। ৪৫০ টি কেস কোর্টে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল, ৩০৩টি কেস ছিল পুলিশের কাস্টাডিতে।
কৃষকদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ ছিল নিজেদের ফসল নিজেদের খেয়াল খুশী মত খরচ করবার সুযোগ, সরকারের কাছে স্বাধীনতা মানে ছিল নূতন রাষ্ট্র গঠনের নিমিত্তে ত্যাগ তিতিক্ষা। কিন্তু সেই সাধারণ কৃষকেরা স্বাধীন দেশের নির্বাচিত সরকারের কাছেও উদ্বৃত্ত ফসল জমা দিতে চায় নি। তাদের কাছে স্বাধীনতা মানে ছিল কোন স্বৈরাচারী দাবীর সামনে শির নত না করা।
কার্ল ভন ভরিসের মতে পূর্ব পাকিস্তানের বেশীর ভাগ মানুষের কাছেই এই “জাতীয় স্বার্থ” ব্যাপারটা যে কি – সেটাই ছিল অস্পষ্ট। প্রত্যহকার টানা পোড়েনে নিজের ব্যাক্তিগত সুবিধা অসুবিধার চেয়ে অস্পষ্ট “জাতীয় স্বার্থ” – ব্যাপারটাকে বড় করে দেখবে এরকম দৃষ্টান্ত ছিল খুবই কম।
১৯৫০ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোপালস্বামী আয়াঙ্গের বলেন যে ১৯৪৭ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি থেকে নিয়ে ১৯৪৯ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত সর্বমোট ৪,৫০,০০০ মুসলমান ভারতের আসামে প্রবেশ করেছে। চিটাগং মুসলিম লীগের এক সাংসদের প্রশ্নের জবাবে সরকার স্বীকার করে যে ১৯৪৮ সালের মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে সর্বমোট ১০,০০০ জন বাঙ্গালী বার্মায় চলে গেছে। কারণ বার্মার আকিয়াব শহরে খাদ্যশস্যের ছড়াছড়ি এবং সেখানে আবাসস্থলের ও অভাব নেই। কাজেই দেশত্যাগকৃত মানুষের সর্বমোট সংখ্যা খুব বেশী না হলেও সংখ্যাটি তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।
এই ঘটনাটি পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে “পায়ের ভোট” – নামে অভিহিত করা হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠী ব্যালট পেপারে বা আন্দোলন সংগ্রামের দ্বারা সরকারের বিরোধিতা করার সুযোগ না পেয়ে হাতের বদলে পা দিয়ে ভোট দেয়, অর্থাৎ দেশত্যাগ করে।
খাদ্য ব্যাবস্থাপনার ক্রমাগত দুর্গতি মুসলিম লীগের নেতাদের একদিকে যেমন আত্মশ্লাঘায় আঘাত করে, তেমনি তাদের মনে দেশে বলশেভিক বিপ্লবের আশঙ্কা তৈরি করে। মার্চ ১৯৫২’র অধিবেশনে মুসলিম লীগের এক সাংসদ বলেন – যে কমিউনিস্টদের ভয় তাদের মনে সদা বিরাজমান, তাদের আর মস্কো থেকে আমদানি করে আনতে হবে না। দেশের অর্থনীতির এই অবস্থা চলতে থাকলে সমাজের ভুখা-নাঙ্গা শ্রেণীর মানুশগুলিই একএকটি পাক্কা কমিউনিস্ট হয়ে উঠবে।
জনগনের ভুবণ্টন এবং কৃষি ব্যবস্থাপনা
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারন হিসেবে আসে – ভুবন্টন এবং কৃষি ব্যবস্থাপনায় মুসলিম লীগের ব্যারথতা। স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের সাথে রাজনৈতিক স্বাধীনতার যে আশা জন্মেছিল দেশটির উপজাতি, দরিদ্র নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায় এবং দরিদ্র মুসলিমদের মধ্যে তা তিক্ততায় পর্যবসিত হয় দ্রুততার সঙ্গে। অজানা যে শঙ্কা তাদের মধ্যে কাজ করছিল, তা বাস্তবে পরিণত হয় স্বাধীনতার চাকা এক বছর গড়াতে না গড়াতেই। সরকারের দেশ গঠনের পরিকল্পনার সাথে সামাজিক ও ভৌগলিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর স্বার্থে আঘাত হানে। স্বার্থে আঘাত লাগার ফলশ্রুতি গড়ায় মিছিল মিটিং থেকে নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম- প্রতিরোধ পর্যন্ত। ১৯৫০এর শুরু থেকে ১৯৫১র মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে এ অরাজক অবস্থা বিরাজ করে।
কমিউনিস্ট কর্মী এবং ইতিহাসবিদেরা এই আন্দোলনের নাম দেন – হাজং, নানকার এবং নাচোল বিদ্রোহ। হাজংরা ময়মনসিংএর উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী। নানকারেরা ছিল কাজের বিনিময়ে থাকা খাওয়ার বরাদ্দ পাওয়া সিলেটের অধিবাসি। আর নাচোল বিদ্রোহের নামকরণ করা হয় রাজশাহী জেলার নাচোল পুলিশ স্টেশনের ওপর যেখানে ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে সাঁওতাল এবং স্থানীয় দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর সাথে পুলিশের সংঘর্ষ বাঁধে। এই সমস্ত অঞ্চলই ছিল ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে।
প্রতিক্রিয়াশীল ইতিহাস লিপিবদ্ধকারীরা এই বিদ্রোহগুলির ইতিহাস সংকলন করতে গিয়ে একটি বড় ধরণের ভুল করেন। এই বিদ্রোহগুলি- যা সরকারীভাবে কমিউনিস্ট পার্টির কুকীর্তি বলে চালানো হচ্ছিল, এগুলো পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তর রাজনীতির অংশ হিসেবে না ধরে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে একটি চটজলদি উপসংহারে পৌঁছানোর চেষ্টা করা। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চিন্তার ধ্বজাধারীরা এই বিদ্রোহীদেরকে সমাজের একদম প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের কাতারে ঠেলে দেয়।
তেভাগা আন্দোলনের মুখ্য দাবী ছিল – জমির মালিক এবং বর্গাচাষিদের মধ্যে উৎপন্ন ফসলের ভাগাভাগি সমান সমান হবে না। চাষিরা পাবে উৎপন্ন ফসলের দুই তৃতীয়াংশ আর জমির মালিক পাবে এক তৃতীয়াংশ।আন্দোলন চলা কালে প্রায় পাঁচ হাজার আন্দোলনকারীকে আটক করা হয়, পঞ্চাশজনের মত আন্দোলনকারীকে হত্যা করা হয়। অপরদিকে কোন জমিদার বা জোতদারের মারা গেছে বা তাদের কাচারিঘরে আগুন দেয়া হয়েছে – এমনটি শোনা যায় নি।
নানকার বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল কৃষকদের অতিরিক্ত গায়ে খাটানোর যে ছক জোতদার এবং জমিদারেরা কষেছিল- সেটা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা। এই পদ্ধতিতে প্রত্যেক বর্গাচাষিকে মাসে পাঁচ থেকে সাতদিন পর্যন্ত বিনিমাগনার খাটুনি দিতে হত জোতদার বা জমিদারের বরাদ্দকৃত জমিতে। এই রুটিনওয়ারী কাজ করাটা নানকারদের জন্যে অনেক কঠিন হয়ে যায়। তাদের প্রত্যেকের যে ছোট্ট একটুখানিক জমি ছিল তাতে মোটেও সময় দিতে পারতো না বিধায় তার ফলনও একদম কমে যায়। সবকিছু মিলিয়ে চলতে গিয়ে যদি কোনভাবে ভূস্বামীর জমিতে বরাদ্দ সময় অনুযায়ী কাজ করতে নানকারদের কেউ ব্যার্থ হত তবে তার ওপর নেমে আসতো শাস্তির খাঁড়া। দুস্থ নানকারদের পরিবার থেকে স্ত্রী-কন্যা-ভগ্নীদের জমিদার এবং ভূস্বামীর পরিবারের পুরুষ সদস্যরা সম্ভ্রমহানী করতো অহরহ।
তেভাগা আন্দোলনের দাবী মেটানোর সাথে জমিদারী প্রথার রদ, তানকা, নানকার পদ্ধতির বিলুপ্তিতে সরকারের গড়িমসির ফলে জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছিল ক্রমশ। ভূস্বামীর স্থাবর সম্পত্তির ওপর বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা চালায়। ময়মনসিংএর উপজাতি হাজং, দালু এবং দরিদ্র মুসলিমেরা মিলে জমিদারের গোলাঘরে লুটতরাজ চালায়। তারা নিজেরা সংঘবদ্ধ হয়ে এইসব লুটপাটের কাজ করতো। জমিদারদের কাছে তারা ছিল সন্ত্রাসী দল।
বিদ্রোহীরা প্রায় ৪০০ গ্রাম জুড়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে সে সমস্ত অঞ্চলের জমি ছিনিয়ে নেয় এবং দরিদ্র কৃষকদের আবাদ করার জন্যে বিলি করে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিবিধ প্রতিষ্ঠান থেকে ফসল ছিনিয়ে নিয়ে দুর্ভিক্ষ পীড়িত জনসাধারণের মধ্যে বণ্টন করা হয়। উপনিবেশিক সরকারের ছায়া বহন করে চলা সরকারী কোর্ট কাচারি অমান্য করে তারা জনতার আদালত স্থাপন করে। জমিদার এবং সরকারকে অতিরিক্ত কোন খাজনা দেয়া থেকে তারা বিরত থাকে।
রাজশাহীর নাচোল এবং নবাবগঞ্জ এলাকায় সাঁওতালী আদিবাসী কৃষকেরা তাদের নেতা মাতলা সর্দার এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ইলা মিত্র ও তার স্বামী রমেন মিত্রর অধীনে জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
পুলিশের সাথে সাঁওতালীদের সাথে একটি অ্যামবুশে সাঁওতাল কৃষকেরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং তাতে পাঁচ পুলিশ অফিসার মারা যায়। ঘটনার ফলাফল হয় ভয়াবহ। ঐ অঞ্চলে শতশত পুলিশ পাঠানো হয় যারা পুরো অঞ্চল জুড়ে তাণ্ডব চালায়। আদিবাসীদের ওপর গুলি চালানো হয়, ২২ জন আদিবাসীকে তারা পিটিয়েই মেরে ফেলে। অসংখ্য সাঁওতালী আটক হয়। তাদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। ফলশ্রুতিতে শতশত সাঁওতালী আদিবাসী এবং দরিদ্র হিন্দু উক্ত স্থল ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায়। ইলা মিত্রও অন্যান্য সাঁওতালদের সাথে আটক হন। পরবর্তীতে কোর্টে দাঁড়িয়ে তিনি অভিযোগ করেন যে জেল হাজতে তারওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়েছে এবং তাকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
সরকার এবং জমিদার – উভয়পক্ষই আবিষ্কার করে, পূর্ব পাকিস্তানের গোত্রবদ্ধ এ সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্দোলন থামিয়ে দেবার সবচে মোক্ষম পদ্ধতি হল জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেয়া। সরকার এবং মুসলিম লীগের নেতাকর্মীরা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করে বলে বেড়াতে লাগলো – “খাজনা- তানকা এগুলো দিতে না চাওয়া বাহ্যিকভাবে ভালো মনে হলেও এর ফলে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে”
ফলশ্রুতিতে প্রচুর মুসলমান পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু- আদিবাসী এমনকি দরিদ্র মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ করে তাদের সম্পত্তি লুটপাট করে। দেখা যায় ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় যে পরিমাণ হিন্দু ভারতে দেশান্তরী হয়, ১৯৫০এ এসে তারচেয়ে বেশী সংখ্যক সংখ্যালঘু ধর্মালম্বিরা দেশত্যাগ করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় মুসলিম লীগ সরকার কতটা ব্যার্থ ছিল – এটা তারই প্রমাণ।
যাই হোক, ১৯৫০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, আড়াই বছরের দাবী দাওয়া, আন্দোলন সংগ্রামের শেষে পূর্ব বাংলা ভূমি মালিকানা এবং কৃষক অধিকার আইন পাশ হয়। কিন্তু সেই আইন কার্যকর করতে করতে আরও ছয়মাস লেগে যায়। তানকা পদ্ধতিও একই সাথে বিলুপ্ত হয়, কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় নি। হাজংদের জোরপূর্বক তাদের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করা হয়ে গিয়েছে ততদিনে। ভারত থেকে আসা মুসলিম অভিবাসীরা তাদের জমিজমা দখল করে নেয়। তানকা বাতিলে বিজয় উৎসব করার জন্যে তেমন হাজং আদিবাসী আর বাকি থাকে নি।
পানির রাজনীতি
মুসলিম লীগের পতন ডেকে আনে তাদের তৃতীয় যে ভুল, তা হল পানি ও জলাশয়ের সংস্কারে গড়িমসি। বঙ্গপ্রদেশের নদীপথের নাব্যতা সংরক্ষণ, রাস্তাঘাট সংস্কার, পুল ও বাঁধ নির্মাণ, খাল খননসহ জনহিতকর কাজগুলি নিয়ন্ত্রণে মুঘল আমলে “চৌকি” এবং “পুলবন্দী দফতর” ছিল। ব্রিটিশরা সেটা উঠিয়ে দেয়। জমিদারেরাও পুলবন্দীর দায়িত্ব থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। স্থানীয় হাট-বাজার চলা কালে সেখান থেকে হাট-বাজারের সংরক্ষণ এবং নদীপথের নাব্যতা সংরক্ষনের জন্যে যে টোল তোলার ব্যাবস্থা ছিল সেটা বন্ধ করে দেয়া হয়।
ব্রিটিশরা তো সেচ কাজের ব্যাপারে কোন ধারণাই রাখতো না। যুদ্ধের পর এসকল খাল-বিল অযত্নে পড়ে থাকতে দেখে তারা ভেবেছিল শুধুমাত্র যাতায়াতের কাজেই এ সমস্ত জলপথ ব্যাবহৃত হয়। কাজেই ও নিয়ে তারা আর মাথা ঘামায় নি। এত বিশাল সংখ্যক জলাভূমি সংরক্ষনে যে একটা বিস্তারিত এবং যত্নশীল পরিকল্পনার প্রয়োজন হতে পারে তা ব্রিটিশ রাজের শেষ দিন পর্যন্ত মাথায় আসে নি।
কিন্তু কৃষিকাজের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পানি সেচের কাজে প্রয়োজন পড়তো নদী থেকে পানি আনার। এই ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগন নবগঠিত মুসলিম লীগ সরকারের কাছে সাহায্য চাইলে মন্ত্রী আবার ঘুরে ফিরে তাদের স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দ্বারস্থ হবার পরামর্শ দেন। কারণ মূল নির্দেশনাটা ছিল সংবিধানেই। সংবিধানের ২৫ নম্বর সেকশনের বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত নীতিমালা অনুযায়ী ডিসট্রিক্ট কালেক্টর, তথা জেলা প্রশাসকের হাতেই ছিল বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত সমস্যায় সকল সিদ্ধান্ত নেবার এখতিয়ার। তদুপরি ব্রিটিশ আমলে গড়ে তোলা সমস্ত রেল লাইন এবং পাকা রাস্তা পানির স্বাভাবিক গতিপথে বাধা সৃষ্টি করে বন্যার সৃষ্টি করে।
মাদারশায় হালদা নদীর বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার লোকের জমায়েতে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সিদ্ধান্তটি ছিল হালদার নদীর পানি ব্যাবস্থাপনা সংক্রান্ত সরকারী যে সিদ্ধান্ত, তার সাথে সাংঘর্ষিক। মাদারশার জনগণের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের একটি রাজনীতি সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়। তারা সংশ্লিষ্ট বিশয়ক মন্ত্রীকে একদম দাওয়াত দিয়ে এনে নিজেদের এলাকার দুঃখ-দুর্দশা প্রদর্শন করে এবং চট্টগ্রামের হালদা নদীতে আর একটি বছর বন্যা পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকার অর্থই ছিল আরও একবছরের বন্যায় অন্তত তিনটি থানার পুরো এক বছরের ফসল ধ্বংস হওয়া এবং জনদুর্ভোগ।
মৌসুমি বায়ু চলে গেলে, সেপ্টেম্বর মাসে আক্রান্ত এলাকার লোকজনের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। ঢেঁড়া পিটিয়ে এ সংবাদ জানিয়ে দেয়া হলে এক বিশাল গণজাগরণের সৃষ্টি হয়। সরাসরি প্রশাসনকে এড়িয়ে গিয়েই নিজেদের মত করে বন্যা পরিস্থিতি উন্নয়ন সংক্রান্ত প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হয়।
সরকারী নথিপত্রে পাওয়া যায় যে বুঝিয়ে শুনিয়ে জনগণকে রাজি করতে ব্যার্থ হলে সরকার বলপ্রয়োগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেয়। উক্ত এলাকায় তারা ১৪৪ ধারা জারি করে। জনগণ তা ভঙ্গ করলে পুলিশ গুলি চালায় এবং দশ ব্যাক্তি এতে নিহত হয়। তাদের একজন ছিল আবুল খায়ের চৌধুরী- ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার এবং স্থানীয় স্কুল কমিটির সম্পাদক। আরেকজন ছিলেন আব্দুল জব্বার বলি- স্থানীয় মুসলিম লীগের কর্মী। একই বছরের ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের সাতকানিয়া অঞ্চলের ইয়োচিয়া খাল পুনঃ খননের সময় পুলিশের গুলিতে ১১ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। সেচ মন্ত্রণালয় এবং জনগণের মধ্যে ইয়োচিয়া খাল পুনঃখনন সংক্রান্ত বিরোধ সৃষ্টি হয় পুনঃখননের স্থান নিয়ে।
খাদ্য, ভুবণ্টন এবং পানির – সংস্কার ও বণ্টনের পর আরও কিছু আনুসাঙ্গিক বিষয় ১৯৫৪র প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের পতন ত্বরান্বিত করে। উক্ত ইস্যুগুলি নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করা চাইছি। তন্মধ্যে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের দুর্বৃত্তায়ন, পুলিশের ঔপনিবেশিক মেজাজ বজায় রাখা, জমিদারদের ক্ষমতা সঙ্কুচিত করে আনায় প্রাথমিক ভাবে মুসলিম লীগের গড়িমসি এবং বামপন্থীসহ পূর্ববঙ্গের অন্যান্য বড় নেতাদের কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে প্রাপ্য মর্যাদাটুকু না দেয়া।
প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের আচরণ
সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশ পাকিস্তানে মুসলিম লিগের নেতারা দেশ পরিচালনার অনেক কিছুই সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে তাদের সাহায্য করার জন্যে পাঞ্জাব থেকে ছোট একটি বিমানে করে একদল লোক কোলকাতা দমদম এয়ারপোর্টে নামে ১৫ই অগাস্ট ১৯৪৭ সালে, যাদের হাতে চলে যায় পুরো পূর্ব পাকিস্তানের মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্ব।
কেমন ছিল এই প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তাদের মনোভাব? সেই যে খাদ্যশস্যের সংকটে অভিযুক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের রক্ষা করতে মন্ত্রীরা সংসদে দাঁড়িয়ে বলছিলেন খাদ্যশস্যের ট্যাক্স সংগ্রহকারী সরকারী কর্মকর্তারা তাদের পুত্রসম, উল্টোদিকে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কি আচরণ করতে স্থানীয় জনগণ এবং তাদের নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের সাথে?
সাংবাদিক জিনকিনস মহাসচিব আজিজ আহমেদকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনে সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে বলেন। পাঞ্জাবী মহাসচিব আব্দুল আজিজ বলেন – ‘হি ইজ অ্যান অ্যাস অ্যান্ড এ বেঙ্গলি। হোয়াট মোর কেন ইউ এক্সপেক্ট ফ্রম হিম?’ একজন সচিব দেশের প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে একজন বিদেশি সাংবাদিকের কাছে বলছেন যে প্রধানমন্ত্রী একজন গাধা, তদুপরি সে একজন বাঙ্গাল গাধা, তার কাছে কি উচ্চাশা রাখবো আমি?
মুসলিম লীগ নেতা কামারুদ্দিন আহমেদ বলেন – এই আজিজ আহমেদ প্রায়ই বলতেন – গভর্নমেন্ট আবার কি? আমিই গভর্নমেন্ট।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এই মানসিকতাই প্রতিফলিত হয় নীচের কর্মকর্তাদের ওপর। যেমন খুলনা জেলা প্রশাসক একদা বলে বসেন – “আমার চিন্তা কেবল এখানকার স্থানীয় প্রশাসন নিয়ে নয়, মুসলিম লীগের এই আকাট মূর্খগুলোর ভালোমন্দের চিন্তাভাবনাও আমাকে করতে হয়।” এ যেন সেই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের মুখের বুলি, যারা বেরিয়েছিল সাড়া দুনিয়া জবর দখল করে তার অধিবাসীদের শিক্ষিত করে তুলতে।
জেলা প্রশাসন ছিল মূলত একটি স্বৈরতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে জেলা প্রশাসকের কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যাক্তিগত জীবনযাপনের পদ্ধতি ছিল এককথায় রাজসিক। প্রায় সকল জেলা প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই ছিল অপেক্ষাকৃত কমবয়স্ক এবং অনভিজ্ঞ। থাকার জন্যে শক্তপোক্ত বাংলো, প্রয়োজনেরও বেশী আসবাবপত্র এবং থরে বিথরে সাজানো খাদ্যদ্রব্য তাদের জীবনকে প্রাচুর্যময় করে রেখেছিল। ঐ সময়ে উক্ত শহরের কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলেও জেলা প্রশাসকের বাংলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল। একজন সাংসদ অভিযোগ করে বলেন – প্রাক্তন ইংরেজের বাংলোতে থাকতে গিয়ে এই সরকারী কর্মকর্তারা নিজেদের ইংরেজ ঠাউরে বসছে।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসের মত প্রাথমিক পর্যায়েই শেখ মুজিবুর রহমান এবং নাইমুদ্দিন আহমেদেরা আমলাতন্ত্রকে ব্রিটিশদের এজেন্ট বলে আখ্যা দেন এবং সমালোচনা করেন। রাষ্ট্রের কোষাগারের ওপর চাপ কমানোর জন্যে তারা প্রশাসনের উপরের দিকের অনেক শক্তিশালী পদ ছেঁটে ফেলার পরামর্শ দেন।
পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ
যুক্তফ্রন্ট তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় পুলিশকে ‘খুনি’ বলে আখ্যায়িত করে এবং বলে যে তারা ক্ষমতায় গেলে পুলিশের ক্ষমতা কমিয়ে আনবে, যেটা তাদের ব্যালটে অনেক ভোট সংযুক্ত করে। পুলিশকে খুনি আখ্যা দেয়ার কারন ছিল। পুলিশকর্তৃক সংঘটিত সবচে জঘন্য অপরাধ ছিল, অভিযোগে অস্পষ্টতা থাকা সত্যেও কথায় কথায় বন্দুকের ব্যাবহার এবং গুলি চালানো। সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সাল থেকে নিয়ে অগাস্ট ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত, স্বাধীনতার ১ বছরে ৫৮টি ঘটনায় গুলি। ১৯৪৯ সনে পূর্ববঙ্গ প্রদেশ জুড়ে সর্বমোট ৯০টি গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন এবং আত্মরক্ষার জন্যে গুলি চালানো লাগে বলে তারা ব্যাখ্যা দেয়। যেমন মানিকগঞ্জের বিল গজারিয়ায় মাছ ধরতে আসা সাধারণ জনগণের ওপর তারা গুলি চালায়। ১৯৫২ সালের ২২ জানুয়ারি পুলিশ সাভারের একটি গ্রাম্য মেলায় গুলি চালায় এবং একজন ব্যাক্তিকে হত্যা করে। সেখানে সক্রিয় দুটি জুয়াড়ি দলের মধ্যে একটি পুলিশকে ঘুষ দিলে পুলিশ অন্যটির সদস্যদের তাক করে গুলি ছোড়ে।পুলিশের সাথে যোগসাজশ রেখে নারীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ আসে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা স্টেশনে। গোপালগঞ্জের স্থানীয় নেতা অভিযোগ তোলেন তার এলাকায় রাত হলেই পুলিশ নিজেই ছিনতাই করতে বের হত। রাস্তায় যাকে পেত তার কাছ থেকেই সবকিছু ছিনিয়ে রেখে দিত।
পুলিশের বিরুদ্ধে জনগনের ক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে। যোগেন মণ্ডল, কেন্দ্রীয় সংসদের একজন মন্ত্রী, দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমবর্ধমান অত্যাচারের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত ক্ষোভের সাথে নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন। তাতে তিনি খুব গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেন হিন্দু বা অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের অভিযোগের ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনের বধিরের মত আচরনের ব্যাপারটি। তিনি অভিযোগ করেন যে পুলিশদের মধ্যেই হিন্দু বিদ্বেষী মনোভাব ছিল ষোলআনা এবং সুযোগ পেলেই তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের ওপর অত্যাচার চালাত। সত্য কথাটি হচ্ছে পুলিশকে যে ই অর্থ এবং উৎকোচ প্রদান করতো পুলিশ তার বশবর্তী হয়ে রইত।
পুলিশের ওপর আঘাত করা এবং জেল থেকে আসামি ছুটিয়ে নিয়ে যাবার প্রবণতা দেখা যায় জনগণের মধ্যে। জেল পলাতক আসামি একজনকেও স্থানীয় জনগন পুলিশের কাছে ফেরত দিয়েছে, এমন ইতিহাস নেই বললেই চলে। ১৯৪৯ সনে পুলিশের উপর আক্রমণের সংখ্যা ছিল সর্বমোট ১৫৫টি, যাতে ২ জন মারা যায়। ১৯৫০ সালে পুলিশের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটে ১৫১টি, যাতে ৫ জন মারা যায়।১৯৫১ সালে পুলিশের ওপর আক্রমণের ১১১টি ঘটনা ঘটে, ১৯৫৩ সালে আক্রমন ঘটে ১১২টি, যার মধ্যে ২ জন মারা যায়। তাদের ওপর এই আক্রমন নেমে আসার কারন তাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা। উল্লেখ্য যে কক্সবাজারে পুলিশ সদস্যদের রাস্তায় নেমে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়- ” শালারা! পাকিস্তান এখনও কায়েম হয় নি। ব্রিটিশ পুলিশ এখনও জীবিত আছে।”
জমিদার প্রথা রদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প
পূর্ব বাংলার মুসলিম তৃণমূল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী যুগে যুগে প্রেষণের স্বীকার হয়ে এসেছে শ্রেণী বিভাজনের জন্যে এবং ধর্মীয় কারনে। আর পূর্ববঙ্গে দেই বিভাজনটি মূলত জিইয়ে রাখে পূর্ববঙ্গের উচ্চবর্ণের সনাতন ধর্ম্যাবলম্বি জমিদারেরা। তাদের অত্যাচারের সমানভাবে শিকার হত মুসলিম এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুরা। ১৯৪৭ সালে ২২৩৭ জন বড় মাপের জমির মালিকদের মধ্যে মাত্র ৩৫৮ জন ছিল মুসলিম, বাকি সবই হিন্দু। বণিক এবং তেলি সমাজের টাকার খাতক- যারা মোটা অঙ্কের সুদের বিনিময়ে টাকা ঋণ দিত, তাদের চক্রবৃদ্ধি সুদের করাল গ্রাসের আটক ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী। সেই সুদের হার ১২ শতাংশ থেকে ২৮০ শতাংশ বা ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশী ছিল।
জমিদার ও তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের আবওয়াব খরচা যুক্ত হত এর সাথে। খাল ভরাট, দাখিলা খরচ, পোল খরচ, ডাক মাশুল, ভাণ্ডারী খরচ সহ সমাজসেবামূলক কাজ তথা স্কুল কলেজ স্থাপন, মন্দিরের সুসজ্জা- পূজাপার্বণ, ঔষধের ডিসপেনসারি স্থাপন, প্রজাদের বাড়িতে ঘুমানোর জন্যে পালঙ্ক ব্যাবহারের জন্যে ১০থেকে ২৫ রুপি, বড়মাপের ছাতা ব্যাবহার করলে বা জমিদারের রাজ্যের মধ্যে হাতি ব্যাবহার করলে ২০ থেকে ৪০ রুপি এবং প্রজাদের জন্যে পানির কুপ খনন করার জন্যে যে ট্যাক্স চালু করা হয়েছিল তার নামছিল – বিলাসব্যাসনের দেয়।
খাজনা দিতে দেরী হলেই গুমখুন, বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া, ক্ষেতখামার বিনষ্টিকরণ – ইত্যাদি অত্যাচারের স্বীকার হতে হত। কেউ যদি অত্যাচারের ভার সইতে না পেরে কথায় বা কাজে কোনরূপ অসন্তোষ বা বিদ্রোহী মনোভাব দেখাতো তবে তার ওপর অত্যাচারের আর কোন সীমা থাকতো না। আমিনুল ইসলাম উল্লেখ করেন – বদরপুর অঞ্চলে আইন ভঙ্গকারী দরিদ্র কৃষককে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করা হত বা বেত্রাঘাত করা হত। মুসলমানদের সে সকল হিন্দু জমিদার ও তাদের পাইক পেয়াদারা প্রকাশ্যেই ছোটলোক বলে ডাকতো, জমিদার বংশের ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চারাও মুসলিম প্রজাদের নাম ধরে ডাকতো, যেটা ছিল অপমানের। হিন্দু জমিদার বাড়িতে কোন মুসলিম প্রজা আসলে তাকে বসার জন্যে সর্বোচ্চ মাটিতে চট বিছিয়ে দেয়া হত। কোন ব্রাহ্মণের বাড়ির ছায়াও যদি কোন দরিদ্র মুসলিম মাড়িয়ে যেত তবে পানি আর গরুর গোবর লেপে মুসলমানের পদচারনায় বিনষ্ট বাড়ির পবিত্রতা পুনরুদ্ধার করা হত। জমিদারের জমির সীমানার ভিতরে কোন প্রজাকে প্রয়োজন সত্যেও মিঠা পানির পুকুর বা কূপ খন করতে দেয়া হত না। দেয়া হত না পাকা বাড়ি তুলতে। বেশীর ভাগ হিন্দু জমিদার তার মুসলিম প্রজাদেরকে গরু জবেহ করে কোরবানি করার অনুমতি দিতেন না। আমিনুল ইসলাম এবং কামাল সিদ্দিকি – উভয়েই এই উপসংহারে পৌঁছান যে জমিদারদের তরফ থেকে চাপিয়ে দেয়া এই বৈষম্যমূলক সমাজ কাঠামোই পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে হিন্দু ও মুসলিমদের দুটি পৃথক ধারার রাজনীতিতে বিভক্ত করে দেয়।
দেশভাগের সময় মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা এই ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতিটি খেলে নিপুন ভাবে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ একদা এদেশের মানুষজনকে উদ্দেশ্য করে বলেন – “পাকিস্তান কায়েম না হলে কখনোই এই অঞ্চল জমিদারি প্রথার প্রভাব মুক্ত হবে না”। চিটাগং এর একটি জনসমাবেশে উপস্থিত মুসলিম জনসাধারণকে উদ্দেশ্য করে পূর্ব বাংলার ভাবী মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বলেন – “যদি আমাদের স্বাধীন পাকিস্তানের দাবী আদায় হয় তবে আপনাদের ছেলেপেলেরা মুন্সেফ হবে, তাদের ছেলেপেলেরা হবে ম্যাজিস্ট্রেট, ডেপুটি এবং দারোগা।”
পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শিক অবস্থান কি – এই প্রশ্নের উত্তর না থাকলেও, কিন্তু আদর্শ কোনটা নয় – সে প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার ছিল। পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদকে সরাসরি উপনিবেশবাদ এবং হিন্দুত্ববাদ বিরোধী আদর্শ হিসেবে দাঁড়া করানো হয়। তারা মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ এবং কয়েকশ’ বছর পেছনে ফেলে আসা মুসলিম খেলাফতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের রোম্যান্টিক আইডিয়া ব্যাবহার করে মানুষকে বশে আনতে সক্ষম হয়। এই উদ্দেশ্যে বহু মুসলিম চেতনাধারী লেখক- সাহিত্যিক এবং কর্মীদের বক্তৃতা এবং লেখা মানুষের মাঝে ছড়ানোর হয়।
পাকিস্তানের জন্মকেই পূর্ববাংলার উচ্চবর্ণের হিন্দুরা তাদের পরাজয়ের বিষয়বস্তু, হতাশা, এবং বিশ্বাসভঙ্গের চিহ্ন হিসেবে ধরে। এক হিন্দু নেতার লেখনীতে স্পষ্ট হয় ব্যাপারটি – “হিন্দুরা কখনোই পাকিস্তান চায় নি। বরং পাকিস্তান তাদের মাথার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে”। ঢাকা নিবাসী প্রবীণ মার্ক্সিস্ট জ্ঞান চক্রবর্তীর বয়ানে জানা যায় – হিন্দুরা একদম গোড়া থেকে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবীর বিরোধিতা করেছে। দেশভাগের পরপরই তার ফলশ্রুতিতে বিশাল সংখ্যক হিন্দু জনগোষ্ঠী পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমায়। তার সূত্র মতে প্রায় সকল হিন্দু সরকারী কর্মকর্তা ভারতে দেশান্তরী হয়। কিছু কিছু স্থলে হিন্দুদের মদ্যে প্রতিক্রিয়া এত তীব্র হয় যে তারা দেশত্যাগের পূর্বে পূর্ব বাংলার সরকারী সম্পত্তির প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে যায়। অজয় ভট্টাচার্যের বয়ানে জানা যায় যে সিলেট হসপিটালের হিন্দু এমপ্লয়িরা সিলেট ছেড়ে যাবার আগে সরকারি হসপিটালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে যায়। মুন্সিগঞ্জের জেলখানার হিন্দু কর্মকর্তা এবং জেলে বন্দী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পাকিস্তানের জন্ম উপলক্ষে সবার জন্যে যে অতিরিক্ত রেশন বরাদ্দ করা হয় সরকারের তরফ থেকে তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এইতো সেদিওন যে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা অর্থে-বিত্তে, প্রভাব- প্রতিপত্তিতে পূর্ব বাংলার শীর্ষে অধিষ্ঠিত ছিল, একদম হুট করেই যেন রাজনীতির পাকেচক্রে নিজদেশে তারা অপমানিত হয়ে সে শীর্ষপদ থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়। লাহিড়ীর লেখায় অধিকাংশ হিন্দুদের এই সেন্টিমেন্টটা খুব পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে যে , তখনও তারা সামাজিকভাবে এবং অর্থের দিক থেকে পূর্ব বাংলার সবার থেকে এগিয়ে আছে, অথচ তাদের সামাজিক সে মর্যাদা আর নেই। অপরদিকে দলিত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা, যারা এতদিন বিবিধ সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল তারা মুসলিম লীগের রাজনীতির ব্যাপারে নিজেদের অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে। তবুও বহু আদর্শবাদী হিন্দু রাজনীতিবিদ পাকিস্তান ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। এই অবস্থাতেই দেশে থেকে তারা পাকিস্তানের রাজনীতিতে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে যাবেন বলে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। এমনি একজন হিন্দু রাজনীতিবিদ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী লেখেন –
“সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি পাকিস্তান ছাড়ছি না। আমার এদেশেই থাকতে হবে। এদেশের মানুষের আনন্দ বেদনার সারথি হতেই আমার এখানে থেকে যেতে হবে। পূর্ব বাংলা আমারই তো দেশ… কেন আমি আমার জন্মভূমিকে ছেড়ে যাব?”
তারমত আরও অনেক রাজনৈতিক আদর্শধারী হিন্দুই এই দেশে থেকে যান, যাদের ওপর পরবর্তীতে নানামুখী নিপীড়ন চলতে থাকে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থার ফেরে পড়ে।
বামপন্থী নেতা ও অন্যান্য বড় নেতাদের প্রতি আচরণ
দেশভাগের আগে ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলো মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে ভারতীয় মুসলিমদের জন্যে পৃথক রাষ্ট্রের দাবী ইতিবাচক হিসেবেই নিয়েছিল। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম এবং মুসলিম লীগের হাতে ক্ষমতা এসে পৌঁছানো মাত্রই যেন এদের ঘোর ভাঙ্গে। মুসলিম জাতীয়তাবাদীদের সাথে তাদের সম্পর্ক এতটাই তিতকুটে পর্যায়ে পৌঁছায় যে মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা ছাড়া তাদের গতি থাকেনা। সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর তারা একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে একে অপরের দিকে অস্ত্রও তাগ করে।
কিছু কিছু তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল মার্ক্সবাদী এককাঠী এগিয়ে গিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মকে অন্ধকার যুগের প্রত্যাবর্তন হিসেবে আখ্যা দেয়। ১৯৭১ সালে, দেশভাগের ২৪ বছর পর ধনঞ্জয় দাস নামের খুলনা প্রবাসী এক পূর্বতন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য উল্লেখ করেন যে তার “লজ্জা” বোধ হয় , যখন তার স্মরণ হয় যে তিনি ১৯৪৭এর অগাস্তে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের আনন্দ আয়োজনে অংশ নিয়েছিলেন। এক কমিউনিস্ট কর্মী অবস্থা বর্ণনে রগড় করে লেখেন – “হ্যাঁ, ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে যাবার পর কিছু পরিবর্তন তো এসেছে। এই যেমন ধরুন- আগে ব্রিটিশ সরকারের পুলিশেবাহিনী দমনপীড়ন চালাত, এখন নিজ দেশের পুলিশের হাতে গুঁতো খাই।”
অপরদিকে জিন্নাহ তার স্বভাবসুলভ ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভঙ্গীতে একবার পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনে মুসলিম লীগের ভূমিকা সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন – “মুসলিম লীগ নিয়ে আমার সামনে কোন কথা বলবে না, আমি আর আমার শ্রুতিলেখক মিলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছি”। মুসলিম লীগ দলটি নিয়েই যেখানে তার একরকম তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার মনোভাব ছিল, সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি তার মনোভাব কি হতে পারে, সেটা সহজেই অনুমেয়।
অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হুসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দি মুসলিম লীগের কার্যক্রমের সাথে সকল রকম সম্পর্ক ছিন্ন করে পূর্ব পাকিস্তানে দেশভাগের পর প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠ্যাকা হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট হন।
আবুল কাশেম ফজলুল হক, পূর্ব বাংলার আরেক জাঁদরেল মুসলিম লীগ নেতা দেশ বিভক্তির পর কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে জিন্নাহের কাছে চরমভাবে পরাস্ত হয়ে কলকাতায় নিজ বাসভূমে বসে মনের ক্ষত শুকোচ্ছিলেন।
মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম যিনি কোন দলগত আদর্শের ভিত্তির অভাবে প্রায় ধুঁকতে থাকা দলটিকে প্রাদেশিকভাবে হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা এবং প্রাদেশিকভাবে দলীয় নীতি ও আদর্শ স্থাপন করে দলটিকে পথ দেখান, মুসলিম লীগের নিষ্ক্রিয় ছাত্র সংগঠনকে সক্রিয় করে তুলবার চেষ্টা করে দলটির ভিত্তি মজনুত করার চেষ্টা করেন – তিনিও দেশভাগের ফলে অনেকটা দিশেহারা হয়ে পড়েন। সোহরাওয়ার্দির অনুসরণে তিনি তার পুরো শক্তি নিয়োগ করেন অবিভক্ত বাংলা অর্জনের লক্ষ্যে। সে দাবী আদায়ে ব্যার্থ হবার পর তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় নিজ গ্রামে গিয়ে বসবাস শুরু করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান এবং আবুল মনসুর আহমেদ দেশভাগের পর কলকাতায় অবস্থান করেন।
আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন আহমেদ, শামসুল হোক – সকল গুরুত্বপূর্ণ ঢাকাকেন্দ্রিক মুসলিম লীগ নেতা আহসান মঞ্জিলে অবস্থিত ক্ষমতার তখৎ হতে নিজেদের দূরত্ব মাপছিলেন।
সিলেটকে ভারতের আসাম হতে ছুটিয়ে এনে অবিভক্ত বাংলার অংশ করার পেছনে যার ভূমিকা ছিল অপরিসীম, সেই মহান নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানিকেও কোন সম্মানজনক জায়গা দিতে পারে নি নবগঠিত পাকিস্তান। খুব্ধ মাওলানা ভাসানির নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামি মুসলিম লিগের জন্ম হয়। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে যে দলের হাত ধরে ৭১ এ স্বাধীনতা আসে আমাদের দেশে।
উপসংহারে এসে বলা যায় – যুক্তফ্রন্ট যে শুধুমাত্র তাদের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নে ব্যার্থ হয় তা ই নয়, দলটি অনেক দ্রুত ভেঙ্গে যায়। আওয়ামী লীগ ছিল যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় অংশীদার, যারা সাংসদীয় গনতন্ত্রের পক্ষে কথা বলত, পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে থেকে কখনো রাজনৈতিক ক্ষমতায় যেতে পারে নি। ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের হাতে ধরে দেশে সামরিক শাসন এলে মুসলিম লীগ সামরিক শাসকদের তল্পিবাহক এবং ভূতপূর্ব মুসলিম লীগের প্রেতে পরিণত হয়।
৭১ এ স্বাধীনতা আসে আর ধর্মের ভিত্তিতে নয়, একই ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের বন্ধনের ভিত্তিতে। কিন্তু আওয়ামি লীগ সরকারের পতন হয় মুসলিম লীগের চেয়েও দ্রুত গতিতে, মাত্র চার বছরে।
এরপর আসে সামরিক শাসন, সামরিক শাসনের পর সামরিক শাসকের এক নায়কতন্ত্র, ১৯৯১ সাল থেকে দীর্ঘদিন দেশে গনতন্ত্র বজায় থাকার পর ২০০৭ সালে দেশে পুনরায় সামরিক অভ্যুত্থান হয়। যেটার অবসান ঘটে বর্তমান আওয়ামি সরকারের ২০০৯ সালে নির্বাচিত সরকার হিসেবে ক্ষমতার মসনদ দখলের মাধ্যমে, যদিও তাদের দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার প্রক্রিয়াটি গণতান্ত্রিক কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অনেকেই।
আমাদের দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে গৌরবোজ্জ্বল অংশ যতটুকু, অন্ধকার অংশও ঠিক সমপরিমাণ। এর মধ্যে কোন আশার বানীটি নিয়ে আমরা আজ এখান থেকে পৃথক হব? আমরা এটা জেনে এখান থেকে আজ বাড়ি ফেরত যাবো যে, বাংলার ইতিহাস বলে – যে রাজনৈতিক দল ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠে, তাদের পতন অনিবার্য, তা তারা যত শক্তিশালীই হোক না কেন। জনগণ সমস্ত ক্ষমতার উৎস এবং মালিক, এখানেই গনতন্ত্রের সৌন্দর্য।
The post মুসলিম লীগ (১৯৪৭-১৯৫৪): জনবিচ্ছিন্নতা ও পতনের ইতিহাস appeared first on Bangladesh Study Forum.
লেখক, সমালোচক ও ভাষাতাত্ত্বিক শিশির ভট্টাচার্য্যের গুরুত্বপূর্ণ বই ‘ঈশ্বর ধর্ম বিশ্বাস’ এর প্রথম অধ্যায় ‘সেমিওলজি ও ঈশ্বর’ এর প্রথম অংশ নিচে দেওয়া হলো:
বস্তু ও তার চিহ্ন
মানুষের চারপাশের বস্তুময় জগৎ ও মস্তিষ্কের জগৎ পুরোপুরি আলাদা। মানব মস্তিষ্কে বস্তু নেই, আছে বস্তুর এক রকম ছবি বা মূর্তি। আপনি দেখছেন বা শুনছেন: ‘খোকা কলা খাচ্ছে’। ব্যক্তি খোকা বস্তু কলাটা কামড়ে কামড়ে মুখে নিচ্ছে। গবগব গলুট। কলাটা ধীরে ধীরে চলে গেল খোকার পেটে। খোসাটা পড়ে রইল খোকার হাতে। আপনার চোখের সামনে কদলি ভক্ষণের এই কা-টি যখন ঘটতে থাকে তখন আপনার মস্তিষ্ক কেমন করে তা বোঝে? আপনার মস্তিষ্কে তো খোকাও নেই, কলাও নেই। তারা আছে বাস্তবে। আপনার মস্তিষ্কে সৃষ্টি হয়েছে ১. ব্যক্তি ‘খোকা’, ২. বস্তু ‘কলা’ ও ৩. ক্রিয়া ‘খাওয়া’র তিন তিনটি আলাদা আলাদা ছবি বা মূর্তি। আপনার চোখের সামনে বাস্তবের খোকা যখন কলা খাওয়া শেষ করছে তখন আপনার মস্তিষ্কে খোকার মূর্তির পেটে যাচ্ছে কলার মূর্তি। খোকার মূর্তির হাতে ঝুলে আছে খোসার মূর্তি।
অদ্ভুত লাগছে শুনতে তাই তো? সিনেমা বা টেলিভিশনে যখন কাউকে কলা খেতে দেখেন তখন আপনার সামনে আসলেই কেউ কলা খায় না। কলা খাওয়ার ছবিটা শুধু দৃশ্যমান হয় রূপালী পর্দায়। তবে রূপালী পর্দার ছবি বা বাস্তবের কোনো মূর্তির সাথে মস্তিষ্কে সৃষ্টি হওয়া নিওরোলজিক্যাল ছবি বা মূর্তির তফাৎ আছে। পর্দার শাবনূর বাস্তবের শাবনূরের অবিকল প্রতিরূপ। কোনো শিল্পী যদি খোকার একটি মূর্তি নির্মাণ করেন পাথর, মাটি বা প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে তবে তা হবে বাস্তবের খোকার কমবেশি মূর্ত বা ‘ফিগারেটিভ’ প্রতিরূপ। মস্তিষ্কের মূর্তি সম্ভবত সে রকম কিছু নয়। এই মূর্তিটি খোকার অবিকল প্রতিরূপ হওয়া দূরে থাক, আদৌ কোনো প্রতিরূপ কিনা তাও আমরা জানি না। যা জানি তা হচ্ছে এই: খোকার একটি প্রতিরূপ তৈরি হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কে। প্রতিরূপটি যে খোকারই তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু তার সাথে বাস্তবের খোকার সাদৃশ্য কতটুকু সেটা ভবিষ্যৎ গবেষণায় জানা গেলেও যেতে পারে।
একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিষ্কার হবে। কম্পিউটারের পর্দায় আপনি দেখছেন একটি অক্ষর: ‘ক’। কম্পিউটারের স্মৃতিতে ‘ক’ হচ্ছে বিদ্যুৎকণার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির একটি বিশেষ সমষ্টি। একই ভাবে ‘প’ বিদ্যুৎকণার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির অন্য একটি সমষ্টি। পর্দার ‘ক’ একটি মূর্তি। কিন্তু পর্দার পিছনের বৈদ্যুতিন বা ইলেক্ট্রনিক ‘ক’ একদিক থেকে চিন্তা করলে মূর্তি, আবার অন্যদিক থেকে চিন্তা করলে মূর্তি নয়। মস্তিষ্কের মূর্তি কম্পিউটারের ‘ক’-এর মতো করে সৃষ্টি হয় কিনা তা আমরা এখনও জানি না। অন্ততপক্ষে মূর্তি বলতে আমরা বাস্তবে যা বুঝি তার সাথে মস্তিষ্কে সৃষ্টি হওয়া মূর্তির তফাৎ আছে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
যে কলা কিলোদরে বা ডজন হিসেবে দোকানে বা বাজারে বিক্রি হয় (অর্থাৎ হলুদ রঙের বাঁকানো যে বিশেষ ফলটিকে হাত দিয়ে ধরা যায়, নাকে নিলে একটি বিশেষ ‘কলাটে’ গন্ধ পাওয়া যায়) তাকে আমরা বলব কলা’র ‘নির্দেশিত’ বা Referent । দোকানের তাকে বা দড়িতে এই রেফারেন্ট বা নির্দেশিত ঝুলতে দেখে আপনার মস্তিষ্কে একটি ছবি ভেসে উঠে। এই ছবিটির পোষাকী নাম ‘দ্যোতিত’ বা Signified। মানুষের মস্তিষ্ক বলে কোনো কথা নয়, যে কোনো ধরনের মস্তিষ্কেই দ্যোতিত সৃষ্টি হতে পারে। একটা কুকুরের সামনেও যদি আপনি একটি মাংসের টুকরা ছুঁড়ে দেন তবে কুকুরটি তা তৎক্ষণাৎ চিনতে পারবে এবং মুখে নিয়ে খাওয়া শুরু করবে। সেই একই কুকুরের সামনে আপনি একটি কলা ফেলে দেখুন, সে ছুঁয়েও দেখবে না। এর মানে হচ্ছে এই যে নির্দেশিত দেখে বা শুঁকে কুকুরের মস্তিষ্কেও দ্যোতিত সৃষ্টি হয়।
নির্দেশিত আর দ্যোতিত এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্যটি আশা করি পরিষ্কার হয়েছে। এটুকু মনে রাখলেই চলবে যে ‘নির্দেশিত’ হচ্ছে বাস্তবের বস্তু, আর ‘দ্যোতিত’ হচ্ছে মস্তিস্কে সৃষ্টি হওয়া একটি ছবি বা মূর্তি।
প্রতিমা, প্রতীক ও সঙ্কেত
মানুষের ‘মাংস’ বা ‘কলা’ দেখার দরকার নেই। ‘মাংস’, ‘কলা’ ইত্যাদি শব্দ শুনলে বা এই কথা দু’টি কোথাও লেখা আছে দেখলেই মানব মস্তিষ্কে দ্যোতিতের সৃষ্টি হয়। ‘কলা’ শব্দটার মধ্যে কি আছে? আছে কতগুলো ধ্বনি। ‘ক’, ‘অ’, ‘ল’ আর ‘আ’- এই চার রকমের চারটা ধ্বনি। ধ্বনি চারটি বিশেষ একটি ক্রমে সাজানো থাকলেই শুধু ‘কলা’র বোধ জন্মাবে মস্তিষ্কে, অন্যথায় নয়। ধ্বনি চারটিকে একটু ওলটপালট করে যদি বলেন ‘লকা’ তবে কিন্তু কোনো দ্যোতিতই সৃষ্টি হবে না মস্তিষ্কে। ‘লকা’ বললে কোনো বাঙালিই কিছু বুঝবে না। এই যে এক বা একাধিক ধ্বনি বিশেষ একটি ক্রমে সাজিয়ে নতুন একটি ধ্বনিবস্তু তৈরি হলো তার নাম ‘দ্যোতক’ বা Signifier। দ্যোতক’ তৈরি হতে পারে ধ্বনি দিয়ে, বর্ণ দিয়ে, এমনকি আঁকাও যেতে পারে দ্যোতককে। উচ্চারিত ‘কলা’ ধ্বনি-দ্যোতক, লিখিত ‘কলা’ লিপি-দ্যোতক আর কলার ফটোগ্রাফ বা আঁকা ছবি বা নির্মিত মূর্তি হবে প্রতিমা-দ্যোতক।
মস্তিষ্কে সৃষ্টি হওয়া দ্যোতিত ছবি বা মূর্তি কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও দ্যোতক যে একটি মূর্তি তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। ‘কলা’ এবং ‘কলার ছবি’ এক কথা নয়। কলা খাওয়া যায়, কলার ছবিতে পেট ভরে না। কানের কাছে হাজার বার ‘কলা’ শব্দটা উচ্চারিত হলেও তাতে কলার স্বাদ বা গন্ধ পাওয়া যায় না। কলার ১. ধ্বনিগত ছবি, ২. লেখা ছবি, ৩. আঁকা ছবি এবং ৪. আলোকচিত্র চার ধরনের চারটি আলাদা মূর্তি। ধ্বনিগত ছবির সাথে আঁকা বা আলোকচিত্রের পার্থক্য আছে। যদিও কলার আলোকচিত্রের সাথে বাস্তবের কলার সাদৃশ্য কলার অঙ্কিত চিত্রের তুলনায় কিছুটা হলেও বেশি, তবু এ কথা বলা যায় যে কলার আঁকা ছবি আর আলোকচিত্র কলার কমবেশি অবিকল প্রতিরূপ। যদি কোনো মূর্তি বা ছবির সাথে দ্যোতিতের এ ধরনের অবিকল সাদৃশ্য থাকে তবে সে মূর্তিটিকে আমরা বলব ‘প্রতিমা’ (Icon)। ‘প্রতিমা’ হচ্ছে বস্তুর কমবেশি অবিকল প্রতিরূপ। কলার প্রতিমা দেখে দুনিয়ার সব মানুষই তাকে ‘কলা’ বলে চিনতে পারবে তা যে ভাষাভাষীই সে হোক না কেন যে দেশেই সে থাকুক না কেন।
‘কলা’র প্রতিমার সাথে ‘কলা’র ধ্বনিমূর্তির একটি পার্থক্য আছে। ‘ক্-অ-ল্-আ’ ধ্বনিসমষ্টির সাথে ‘কলা’ নামক ফলটির কোনো প্রকার সম্পর্ক প্রমাণ করা যাবে না। সম্পর্ক নেই তার প্রমাণ একই ‘কলা’র ধ্বনিমূর্তি এক এক ভাষায় এক এক রকম। কোনো ভাষায় ‘কলা’, কোনো ভাষায় ‘ব্যানানা’, কোনো ভাষায় ‘কদলি’। এসব ধ্বনিমূর্তির সাথে ‘কলা’ বস্তুটির সম্পর্ক নেই, আবার সম্পর্ক আছেও। সম্পর্ক যদি না থাকত তবে ‘কলা’ শব্দটি শুনলে বাংলাভাষীর মস্তিষ্কে ‘কলা’র বোধ জন্মাত না। কিভাবে এ সম্পর্কের সৃষ্টি তা আমরা জানি না তবে এতটুকু জানি যে এ সম্পর্ক কাকতালীয়, আপতিক বা Arbitrary যার ইংরেজি তদ্ভব প্রতিশব্দ হতে পারে ‘আবিত্রিক’। দ্যোতক আর দ্যোতিতের সম্পর্কটি যদি আর্বিত্রিক হয় তবে সেই সম্পর্কের ফলে সৃষ্টি হবে একটি ‘সংকেত’ (Sign)। একে ‘চিহ্ন’ বলা যেতে পারত কিন্তু আমরা তা বলব না, কারণ ‘চিহ্ন’ শব্দটিকে আমরা ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহার করব। ধ্বনিমূর্তি, লিপিমূর্তি, প্রতিমা, সঙ্কেত … সবই বিভিন্ন ধরনের ‘চিহ্ন’।
একজন বাঙালি যখন উচ্চারণ করে ‘কলা’ তখন সে একটি ধ্বনিদ্যোতক সৃষ্টি করে। কিন্তু এই দ্যোতক ফরাসি-ভাষীর মস্তিষ্কে কোনো দ্যোতিতই সৃষ্টি করতে পারে না। সুতরাং ‘কলা’ শব্দটি শুনে কোনো ফরাসি কিছুই বোঝে না। কিন্তু ফরাসি যে কলা চেনে না এমন তো নয়। কলা দেখলে তো সে ঠিকই চিনতে পারে এবং গব গব করে খায়। তাহলে সমস্যাটা কোথায় এখানে? আমাদের ফরাসি-ভাষী ‘কলা’ কথাটা শুনে কিছুই বুঝতে পারছে না কেন? বুঝতে পারছে না এ জন্যে যে ফরাসি-ভাষীর মস্তিষ্কে কলার যে দ্যোতিতটি আছে তার সাথে বাংলাভাষার দ্যোতক ‘কলা’’র কোনো সম্পর্ক কখনও সৃষ্টি হয়নি। ফরাসি-ভাষীর মস্তিষ্কে কলার যে দ্যোতকটি আছে তার সাথে ফরাসি ভাষার দ্যোতক Banane (উচ্চারণ:বানান)-এর সংযোগ আছে। একই ভাবে বাংলাভাষীর মস্তিস্কে থাকা কলার দ্যোতিতের সংযোগ আছে বাংলাভাষার দ্যোতক ‘কলা’’র সাথে। সুতরাং Banane হচ্ছে ফরাসি ভাষার সঙ্কেত, ‘কলা’ হচ্ছে বাংলা ভাষার সঙ্কেত। আলাদা আলাদা ভাষা মানে আলাদা আলাদা অনেকগুলো সঙ্কেতের সমষ্টি।
এবার আমরা অন্য একটি চিহ্ন নিয়ে আলোচনা করব। সিনেমাহলে, ক্লাসরুমে বা সেমিনার কক্ষে বৃত্তের মধ্যে সিগারেটের উপর আড়াআড়ি দাগ দেওয়া একটি ছবি দেখা যায়। এই ছবিটিতে সিগারেটের অবিকল প্রতিরূপ নেই। কিন্তু এই ছবি দেখে আপনি বোঝেন যে সিনেমাহলে সিগারেট খাওয়া নিষেধ। সুতরাং এটি একটি দ্যোতক। এই দ্যোতকটির সাথে কোনো বিশেষ স্থানে সিগারেট না খাওয়ার কমবেশি সাদৃশ্য আছে কিন্তু প্রতিমার মতো পুরোপুরি সাদৃশ্য নেই। আর একটি উদাহরণ দেয়া যাক। পৃথিবীর অনেক দেশেই বিদ্যুতের খুঁটি, জেনারেটর, মিটার ইত্যাদির উপর আড়াআড়ি দুই হাড়ের উপর মাথার খুলির একটি ছবি দেখা যায় N। এই ছবি দেখে আপনি বোঝেন যে এই খুঁটি, মিটার বা জেনারেটর থেকে বিপদের আশঙ্কা আছে। এই দ্যোতকটির সাথে মৃত্যু বা বিপদের কমবেশি সাদৃশ্য আছে মাথার খুলির কারণে, কিন্তু প্রতিমার মতো পুরোপুরি সাদৃশ্য নেই। যদি কোনো দ্যোতকের সাথে দ্যোতিতের কমবেশি সাদৃশ্য থাকে তবে সেই চিহ্নটিকে আমরা বলব আমরা ‘প্রতীক’ (Symbol)। হাড়ের উপর খুলির ছবি একটি প্রতীক। ‘গোল বৃত্তে ক্রস দেয়া সিগারেট’ একটি প্রতীক। এ রকম বহু প্রতীক ব্যবহৃত হয় আমাদের নিত্য দিনের জীবনে।¯হচ্ছে সঙ্গীতের প্রতীক,Ûহচ্ছে বৃষ্টির প্রতীক।
প্রতিমার মতোই প্রতীকের একটি সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা আছে। যে কোনো ভাষাভাষী ব্যক্তি যেমন কলার ছবি দেখে ‘কলা’ চিনতে পারে তেমনি কলার প্রতীক দেখেও মস্তিষ্কে ‘কলা’র দ্যোতিত সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। কিন্তু ‘সঙ্কেত’ কোনোমতেই সার্বজনীন চিহ্ন নয়। সি.আই.এ’র গুপ্তচর কে.জি.বি’র সঙ্কেত সাধারণত বুঝতে পারে না। যখন কোনো দরজার উপর বাংলায় লেখা থাকে ‘প্রসাধন’ তখন কোনো ফরাসিভাষীর বোঝার সাধ্য নেই যে দরজাটি টয়লেটের। এর কারণ, ‘প্রসাধন’ কোনো প্রতিমা বা প্রতীক নয়, এটি একটি সঙ্কেত।
ভাষাসৃষ্টির সূচনাপর্বে কথ্য ভাষার ধ্বনিদ্যোতকগুলোর সাথে এগুলোর দ্যোতিতের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল কিনা অর্থাৎ এগুলো প্রতিমা জাতীয় চিহ্ন ছিল কিনা তা আজ হাজার বছর পরে নির্ধারণ করা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু এটা জানা গেছে যে লিখিত ভাষার অন্যতম উপাদান ‘বর্ণ’ প্রতিমা ও প্রতীক জাতীয় চিহ্ন থেকে উদ্ভূত হয়েছে। গ্রীক আলফা, আরবি আলিফ বা বাংলার ‘স্বরে-অ’ তিনটি বর্ণেরই মূল হচ্ছে একটি সুমেরীয় বর্ণ যা তৈরী হয়েছিল গরুর মাথার আদলের অনুকরণে। প্রাচীন মিশরীয় ভাষা লেখা হত চিত্রলিপিতে। ‘খোকা কলা খায়’ বাক্যটি লিখতে এই লিপিতে, ধরা যাক, ‘একটি শিশু’, ‘একটি কলা’ আর একটি ‘হা-করা মুখ’ ব্যবহার করা হত। সুতরাং এটি ছিল একান্তই একটি ‘প্রতিমালিপি। এই প্রতিমালিপি বিবর্তিত হয়ে হাজার খানেক বছর পরে সৃষ্টি হয় কীলক লিপি। কীলক লিপির দ্যোতকগুলোর সাথে নির্দেশিতের সাদৃশ্য ছিল বটে কিন্তু চিত্রলিপির তুলনায় এই সাদৃশ্য ছিল অনেক কম। কীলক লিপিকে বলা যেতে পারে ‘প্রতীকলিপি’। এই কীলকলিপি জাতীয় কোনো লিপি থেকেই সম্ভবত প্রাচীন সুমেরিয়দের হাতে বর্ণমালা বা সঙ্কেত লিপি উদ্ভাবিত হয় এবং ধীরে ধীরে এই লিখনপদ্ধতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যায়। এই বিবর্তন অবশ্য সব দেশে সমানভাবে হয়নি। দূরপ্রাচ্যের দেশ চীন ও জাপানে এখনও প্রতীকলিপিতে ভাষা লিখিত হয়। জাপানি ভাষা লিখতে প্রতীকলিপি (কাঞ্জি) ও সঙ্কেত লিপি (হিরাগানা ও কাতাকানা) এই দুইই ব্যবহৃত হয়। তবে কাঞ্জি একটি বিশেষ ধরনের প্রতীক। সাধারণ প্রতীকের তুলনায় কাঞ্জির সঙ্গে এর নির্দেশিত বস্তুর সাদৃশ্য অনেক কম। চিহ্ন হিসেবে কাঞ্জি সংকেতের কাছাকাছি কিছু।
চলবে—
The post সেমিওলজি ও ঈশ্বর-প্রথম পর্ব appeared first on Bangladesh Study Forum.
লেখক, সমালোচক ও ভাষাতাত্ত্বিক শিশির ভট্টাচার্য্যের গুরুত্বপূর্ণ বই ‘ঈশ্বর ধর্ম বিশ্বাস’ এর প্রথম অধ্যায় ‘সেমিওলজি ও ঈশ্বর’ এর দ্বিতীয় অংশ নিচে দেওয়া হলো:
মানবভাষা সঙ্কেতের সমষ্টি
মানবভাষায় অনেক প্রতীক ব্যবহৃত হয় কিন্তু প্রতীক দিয়ে ভাষা সৃষ্টি হয় না। কেন হয় না? হয় না, কারণ সঙ্কেতের এমন একটি গুণ আছে যা প্রতীকের নেই। সঙ্কেত সাধারণত একা ব্যবহৃত হয় না। আগেই বলা হয়েছে, ভাষা অনেকগুলো সঙ্কেতের সমষ্টি। একটি সঙ্কেত অন্য একটি সঙ্কেতের কোন পাশে বসল এই তথ্যটি ভাষার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘খোকা কলা খায়’ বাক্যে তিনটি সঙ্কেতের মধ্যে কোনটি কোন জায়গায় বসবে তা মোটামুটি স্থির হয়ে থাকে ভাষার ব্যাকরণে। সঙ্কেতের এই পারষ্পরিক অবস্থানকে বলা হয় ‘সিন্টাক্টিক’ যাকে আমরা বাংলায় বলব ‘বিন্যাস’। প্রতীকের ক্ষেত্রে এই বিন্যাস ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ‘সিগারেট খাওয়া বারণ’ দ্যোতিত করার জন্য ব্যবহৃত হয় তিনটি দ্যোতক: ১. সিগারেট, ২. গোল বৃত্ত এবং ৩. আড়াআড়ি দাগ বা ক্রস চিহ্ন। সিগারেটের প্রতীকটি বৃত্তের বাইরে, উপরে বা নীচে থাকলে প্রতীকের তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। লোক তখনও বুঝতে পারবে: ‘সিগারেট খাওয়া বারণ’। কিন্তু ‘মানুষ বাঘ মারে’ না বলে যদি কেউ বলে ‘বাঘ মানুষ মারে’ তবে সঠিক ‘সঙ্কেতায়নের’ কাজ থেমে যায় বললেই চলে।
মানব ভাষার অন্যতম উপাদান সঙ্কেত। সঙ্কেত সৃষ্টির জন্য মানুষের দরকার ছিল: ১. দ্যোতক সৃষ্টি করতে পারা এবং ২. দ্যোতিতের সাথে দ্যোতকের সম্পর্ক বা সংযোগ সৃষ্টি হওয়া। ভাষাসৃষ্টির জন্য দ্যোতক আর দ্যোতিতের এই সম্পর্কটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানব-মস্তিষ্ক আর মানবদেহ এ দু’টিই একসঙ্গে প্রতীক সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে। বহু লক্ষ বছর ধরে মানুষের শরীরকে এর জন্যে ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে। এ কথা বলা যাবে না যে মানবশরীরের উপরোক্ত বিবর্তন মানুষকে কথা বলতে সক্ষম করার জন্যেই হয়েছে। যে কোনো কারণেই হোক, এই বিবর্তনের ফলে মানবশরীর এক বিশেষ অবস্থায় আসার কারণে মানুষের পক্ষে কথা বলা সম্ভব হয়েছে। প্রথমত মুখ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের স্বর ও ব্যঞ্জনধ্বনি সৃষ্টি করার জন্য ১. গলার হলকুম (অর্থাৎ এ্যাডাম্স অ্যাপল বা ল্যারিঙস)-কে নীচে নামতে হয়েছে, ২. দাঁতকে মুখের ভিতরের দিকে ঢুকে বর্তমান অবস্থায় আসতে হয়েছে; ৩. জিহ্বাকে প্রায় সর্বত্রগামী হতে হয়েছে মুখগহ্বরে, এবং একই সাথে ৪. মস্তিষ্ককে যথেষ্ট বিকশিত হতে হয়েছে যাতে দ্যোতক সৃষ্টি ও এর সাথে দ্যোতিতের সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হয়।
বলাবাহুল্য, মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণীর এই বৈশিষ্ট্যগুলো নেই। শিম্পাঞ্জির এই সব বৈশিষ্ট্য কিছু কিছু আছে বলে শিম্পাঞ্জি কয়েকটি স্বরধ্বনি সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু শিম্পাঞ্জির পক্ষে কথা বলা সম্ভব নয়। রূপকথায় পশুপাখির কথা বলার যে গল্প আমরা শুনি তা একান্তই গালগল্প। পশুদের কোনো ভাষা নেই, অন্তত মানুষের মতো ভাষা নেই কারণ পশুর দেহমনই মানুষের মত বিকশিত নয়। পশুরা যেমন কথা বলতে পারে না তেমনি ছবিও আঁকতে পারে না। সঙ্কেত দূরে থাক, প্রতীক সৃষ্টির ক্ষমতাও যে কোনো পশুর নেই তার প্রমাণ সবচেয়ে বুদ্ধিমান শিম্পাঞ্জিটিও একটি দুই বছরের মানবশিশুর মতো ছবি আঁকতে পারে না।
ছবি আঁকার সাথে কথা বলার সম্পর্ক থাকা অসম্ভব নয়, কারণ ভাষা সঙ্কেতের সমষ্টি এবং যে কোনো সঙ্কেতের দুই দিকে থাকে দুই দুইটি ছবি। ছবি আঁকার ক্ষমতাও মানবমস্তিষ্কে একদিনে তৈরি হয়নি। গুহামানব তার মস্তিষ্ক-বিবর্তনের ঠিক কোন পর্যায়ে ছবি আঁকতে শুরু করেছে বা ভাষা আবিষ্কার করেছে তা আমরা জানি না। মর্গান ও এঙ্গেলসের মতে, আগুন আবিষ্কারেরও আগে বা সমসাময়িক সময়ে মানুষ মানুষে স্পষ্ট উচ্চারণ কথা বলতে শেখে। ছবি আকার ক্ষমতা অর্জন করার পর মানুষ কথা বলার ক্ষমতা অর্জন করেছে এ রকম ধারণা সম্ভবত অযৌক্তিক নয়।
সাদৃশ্যমূল্য ও নির্দেশিত
আমরা উপরে তিন ধরনের চিহ্নের কথা বলেছি: ১. প্রতিমা, ২. প্রতীক ও ৩. সঙ্কেত। প্রতিমার ক্ষেত্রে দ্যোতক ও নির্দেশিতের মধ্যে আকৃতিগত মিল আছে, সঙ্কেতের ক্ষেত্রে এই মিল অপেক্ষাকৃত কম আর সঙ্কেতের ক্ষেত্রে এই মিল একেবারেই নেই। অন্য ভাবে বলা যায়, সঙ্কেতের ক্ষেত্রে দ্যোতিত বা নির্দেশিতের সাথে দ্যোতকের সংযোগ বা সম্পর্ক আর্বিত্রিক কিন্তু প্রতিমার ক্ষেত্রে দ্যোতক ও নির্দেশিতের মধ্যে আকৃতিগত মিলের কারণে এ সম্পর্ক আর্বিত্রিক নয়। আর্বিত্রিক সম্পর্কের ধরনটাই এমন যে সম্পর্ক থাকলে থাকবে, না থাকলে নেই। সম্পর্ক যেখানে আছে সেখানে প্রশ্ন তোলা যাবে না সম্পর্ক থাকার কারণ কী, আর সম্পর্ক যদি না থাকে সেক্ষেত্রেও জিগ্যেস করা যাবে না, সম্পর্ক নেই কেন। কেন ‘কলা’ শব্দ দিয়ে ‘কলা’ ফলটি বোঝানো হচ্ছে তার কোনো সন্তোষজনক উত্তর দেয়া যাবে না। অন্যদিকে কলার মূর্তি, অঙ্কিত চিত্র বা আলোকচিত্র দিয়ে কেন কলা বোঝানো হচ্ছে সে প্রশ্ন কেউই করবে না।
আমরা বলেছি, প্রতিমা, প্রতীক ও সঙ্কেতের পার্থক্যের মূলে আছে নির্দেশিতের সাথে দ্যোতকের সাদৃশ্যের তারতম্য। নির্দেশিতের সাথে দ্যোতকের এই সাদৃশ্যকে বলা যেতে পারে যাকে বাংলায় আমরা বলতে পারি ‘সাদৃশ্যমূল্য’ (Symbolic value )। সব চিহ্নের ক্ষেত্রে দ্যোতক ও নির্দেশিতের সাদৃশ্যমূল্য এক নয়। সাদৃশ্যমূল্যের এই তারতম্যকে একটি স্কেল বা মাপকাঠিতে দেখানো যেতে পারে: প্রতিমা > প্রতীক > সঙ্কেত। নির্দেশিতের সাথে সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য প্রতিমার। সাদৃশ্যের মাপকাঠিতে অতঃপর আসে প্রতীক এবং সবশেষে সঙ্কেত। সিগারেটের আলোকচিত্র হবে সিগারেটের ‘প্রতিমা’। এর সাদৃশ্যমূল্য সবচেয়ে বেশি। সিগারেটের প্রতীকের সাদৃশ্যমূল্য সিগারেটের প্রতিমার তুলনায় কম। প্রতিমা জাতীয় চিহ্নের ক্ষেত্রে নির্দেশিতের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, কারণ নির্দেশিতের সাথে দ্যোতকের সাদৃশ্যের উপর নির্ভর করে প্রতিমার অস্তিত্ব। কলমের প্রতিমা যদি বাস্তবের কলমের মতো না হয়ে খাতার মতো হয় তবে সেটিকে কলমের প্রতিমা হিসেবে মেনে নেওয়া যাবে না। প্রতিমার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নির্দেশিত থাকতেই হবে এবং এই নির্দেশিতের সাথে দ্যোতকের সাদৃশ্য অপরিহার্য (এমনি অপরিহার্য যে নির্দেশিত না থাকলে প্রতিমাও থাকবে না)।
প্রতীকের ক্ষেত্রে এই বাধ্যবাধকতা অপেক্ষাকৃত কম। কোনো নির্দেশিত নেই এমন প্রতীকও রয়েছে। © প্রতীকটি ‘ভালোবাসা’ দ্যোতিত করে। ভালোবাসা মানব মনের একটি অনুভূতি, এটি বাস্তবের কোনো বস্তু নয়। সুতরাং © প্রতীকটির কোনো নির্দেশিত নেই। কেউ বলতে পারেন, প্রতীকটির সাথে মানুষের হৃদপিণ্ডের আকৃতির মিল আছে। কিন্তু আমরা জানি, ভালোবাসা থেকে শুরু করে যে কোনো অনুভূতি যদি কোথাও থেকে থাকে তবে তা থাকবে মানুষের মস্তিষ্কে, মানুষের হৃদয়ে নয়। সুতরাং হৃদপিণ্ডের সাথে ভালোবাসার যে সম্পর্ক কল্পনা করা হয় তা একান্তই মানুষের সামাজিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ।
লিখিত ও উচ্চারিত উভয় প্রকারে ‘সিগারেট’ একটি সঙ্কেত। লিখিত চারটি অক্ষর: সি-গা-রে-ট বা এসব অক্ষর দ্বারা নির্দেশিত ধ্বনি ‘স-ই-গ-আ-র-এ-ট’-এর সাথে সিগারেটের সাদা কাগজ, বাদামি তামাক বা এর সরু আঙুলের মতো আকৃতি বা পুড়তে থাকা সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে কোনো প্রকার সাদৃশ্য কল্পনা করা যাবে না। সুতরাং সাদৃশ্যমূল্যের মাপকাঠিতে সঙ্কেতের স্থান সবার নিচে। সঙ্কেত জাতীয় চিহ্নের ক্ষেত্রে নির্দেশিতের ভূমিকা সবচেয়ে কম।
সাদৃশ্যমূল্য যত কমতে থাকে, ততই কমতে থাকে নির্দেশিতের ভূমিকা। প্রতিমার সাদৃশ্যমূল্য সবচেয়ে বেশি, প্রতীকের অপেক্ষাকৃত কম, সঙ্কেতের সাদৃশ্যমূল্য শূন্য। প্রতিমার ক্ষেত্রে দ্যোতক ও নির্দেশিতের সাদৃশ্য যেহেতু সবচেয়ে বেশি, সেহেতু প্রতিমার জন্যে নির্দেশিত থাকা অপরিহার্য। প্রতীকের ক্ষেত্রে সাদৃশ্যমুল্য অপেক্ষাকত কম। স্বাভাবিকভাবেই প্রতীক জাতীয় চিহ্নের ক্ষেত্রে নির্দেশিত থাকার বাধ্যবাধকতা কম এবং সে কারণেই অনেক প্রতীকের নির্দেশিত না থাকলেও চলে। সঙ্কেত জাতীয় চিহ্নে দ্যোতক ও নির্দেশিতের সম্পর্ক আর্বিত্রিক অর্থাৎ সঙ্কেতের সাদৃশ্যমূল্য শূন্য। সাদৃশ্যমূল্য যেহেতু শূন্য সেহেতু নির্দেশিত থাকা বা না থাকায় কিছু আসে যায় না। ভাষিক চিহ্নের জন্য নির্দেশিত গুরুত্বপূর্ণ কোনো উপাদান নয়।
তবে সঙ্কেত-জাতীয় চিহ্নের ক্ষেত্রে নির্দেশিতের প্রত্যক্ষ কোনো ভূমিকা না থাকলেও পরোক্ষ ভূমিকা আছে। ‘কলম’ দ্যোতকটি আপনার পিতামহের মস্তিষ্কে যে দ্যোতিতের সৃষ্টি করত আপনার মস্তিষ্কে তা করে না। আপনার ছোটবেলায় কলমের যে দ্যোতিত ছিল মস্তিষ্কে, আজ আর তা নেই। এর কারণ হচ্ছে ‘কলম’ বস্তু বা নির্দেশিতটির দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে। কত রকম কলমই না বের হয়েছে বাজারে গত বিশ বছরে! ‘লেখা’ বলতে আপনার পিতামহ যা বুঝতেন আপনি তা বোঝেন না। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ‘কলম’ শব্দটি বাঙালি-মনে যে চিত্র ফুটিয়ে তুলছে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঠিক সে চিত্র ফুটিয়ে তুলত না। একুশ শতকের শেষে গিয়ে কলমের নির্দেশিত আরও পাল্টে যাবে, সঙ্গে সঙ্গে পাল্টাবে দ্যোতিতের স্বরূপ, পাল্টে যাবে হয়তো দ্যোতিতটিও। অন্য কোনো দ্যোতক এসে দখল করবে বর্তমান দ্যোতক ‘কলম’-এর স্থান, যেমন আরবি দ্যোতক ‘কলম’ একদিন দখল করেছিল সংস্কৃত দ্যোতক ‘লেখনী’র স্থান। আজকাল অনেকেই কমপিউটারে লেখেন, কলম ব্যবহার করেন শুধু স্বাক্ষর দেবার জন্য। সুতরাং এক শ বছর আগে ‘লেখা’ দ্যোতকটির যে দ্যোতিত ছিল বাংলাভাষীর মনে, আজ আর তা নেই। এভাবে নির্দেশিতের পরিবর্তনের কারণে দ্যোতক ও দ্যোতিত-এই উভয়েরই পরিবর্তন হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, ভাষা সৃষ্টি ও এর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বহিঃপ্রকৃতি আর মানব মস্তিষ্কের মিথস্ক্রিয়া (Interaction) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাঙালি, ফরাসি বা ইংরেজি ভাষামানসের সাথে বহির্জগতের মিথস্ক্রিয়া সম্ভবত এক রকম হয় না। ভাষায় ভাষায় পার্থক্য হওয়ার পেছনে মিথস্ক্রিয়ার এই পার্থক্য সম্ভবত কিছুটা নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
কোনো চিহ্নে সর্বমোট চারটি উপাদান থাকতে পারে: ১. দ্যোতক, ২. দ্যোতিত, ৩. নির্দেশিত এবং ৪. বিন্যাস। প্রতীক ও প্রতিমা জাতীয় চিহ্নের ক্ষেত্রে নির্দেশিতের একটি ভূমিকা আছে, কারণ নির্দেশিতের সঙ্গে দ্যোতকের সাদৃশ্যের উপর নির্ভর করে এই দু’টি চিহ্নের অস্তিত্ব। কলার প্রতিমা যদি একেবারেই বাস্তবের কলার মতো না হয়ে আপেলের মতো হয় তবে সেটিকে কলার প্রতিমা হিসেবে মেনে নেওয়া যাবে না। প্রতিমার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নির্দেশিত থাকে এবং এই নির্দেশিতের সাথে চিহ্নের সাদৃশ্য এমনি অপরিহার্য যে নির্দেশিত না থাকলে প্রতিমাও থাকবে না।
প্রতিটি চিহ্ন এমন এক চতুর্ভুজ যার প্রথম কোণে আছে দ্যোতক, দ্বিতীয় কোণে দ্যোতিত, তৃতীয় কোণে নির্দেশিত আর চতুর্থ কোণে বিন্যাস। সঙ্কেত সম্পূর্ণ বা অসম্পূর্ণ হতে পারে। ‘কলম’ একটি সম্পূর্ণ সঙ্কেত কারণ এর দ্যোতক, দ্যোতিত, নির্দেশিত, বিন্যাস এ চারটি দিকই রয়েছে। যে চিহ্নের দ্যোতক, দ্যোতিত, নির্দেশিত আর বিন্যাস এ চারটি দিকই রয়েছে সেগুলোকে আমরা সম্পূর্ণ চিহ্ন বলতে পারি। অনেক সঙ্কেতের ক্ষেত্রে দ্যোতক কোণটি ভাঙা থাকতে পারে। ‘ঋক বই পড়ে’ বাক্যের ক্রিয়ারূপটি বর্তমান কাল দ্যোতিত করে কিন্তু বর্তমান কাল দ্যোতক কোনো উপাদান এই ক্রিয়ারূপে নেই (‘পড়ে’ ক্রিয়ারূপের ‘এ’ যে কোনো কালে নামপুরুষ কর্তা দ্যোতিত করে)। অনেক সময় দ্যোতিত কোণটিও ভাঙা থাকতে পারে। ফরাসি ভাষায় নঞর্থক ক্রিয়ারূপে দু’টি উপাদান ব্যবহার করা হয় Il ne lit pas (ইল ন্য লি পা) (আক্ষরিক অনুবাদ: সে না পড়ে না)। প্রথম নঞর্থক উপাদানটির কোনো দ্যোতিত নেই, কারণ কথ্য ফরাসিতে এই উপাদানটি ব্যবহার না করলেও চলে: Il lit pas (ইল লি পা)। এ ধরনের ক্ষেত্রে অবশ্য ‘এই সঙ্কেতে কোনো দ্যোতক বা দ্যোতিত নেই’- এমনটি বলা যাবে না। বলতে হবে, ‘এই সঙ্কেতের দ্যোতক বা দ্যোতিত স্থানটি শূন্য আছে।’
সঙ্কেত জাতীয় চিহ্নের ক্ষেত্রে বিন্যাস-কোণটি কখনই ভাঙা থাকতে পারবে না। এ ধরনের চিহ্নের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট বিন্যাস বা সিন্ট্যাক্টিক থাকা বাধ্যতামূলক, অর্থাৎ ‘ক’ ডানদিকে বসবে ‘খ’-এর, নাকি বামদিকে- এ ব্যাপারটা সঙ্কেতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সব প্রতিবেশেই অন্য সঙ্কেতের ডানে বা বামে যে কোনো দিকে বসতে পারে এমন ভাষিক সঙ্কেত বিরল। উদাহরণস্বরূপ, ভাষায় কিছু সঙ্কেত শব্দের বামদিকে যুক্ত হয়: প্রতি-কার, উপ-সর্গ। এগুলো ‘উপসর্গ। কিছু সঙ্কেত আবার শব্দের ডানদিকে যুক্ত হয়: কর-আ, ঢাকা-আই। এগুলো ‘প্রত্যয়। উপসর্গ হিসেবেও ব্যবহৃত হয় আবার প্রত্যয় হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এমন সঙ্কেত বিরল।
চলবে–
প্রথম পর্বের লিংক: http://www.bdsfbd.com/archives/947
The post সেমিওলজি ও ঈশ্বর – দ্বিতীয় পর্ব appeared first on Bangladesh Study Forum.
লেখক, সমালোচক ও ভাষাতাত্ত্বিক শিশির ভট্টাচার্য্যের গুরুত্বপূর্ণ বই ‘ঈশ্বর ধর্ম বিশ্বাস’ এর প্রথম অধ্যায় ‘সেমিওলজি ও ঈশ্বর’ এর তৃতীয় অংশ নিচে দেওয়া হলো:
রূপক: নূতন সঙ্কেত
ধ্বনি অনেক রকমই সৃষ্টি করতে পারে মানুষ মুখ দিয়ে, কিন্তু সব ধ্বনি ভাষায় ব্যবহার করা যায় না। একটি ভাষায় খুব বেশি হলে শ’খানেক ব্যবহারযোগ্য ধ্বনি থাকতে পারে। এই শ’খানেক ধ্বনি দিয়ে লক্ষ লক্ষ শব্দ তৈরি হয়। আরও বহু লক্ষ শব্দ তৈরি হতে পারে কিন্তু সব ধ্বনির সাথে সব ধ্বনি পাশাপাশি বসতে পারে না সব ভাষায়। এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক ভাষাতেই নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়ে হরহামেশাই শব্দ শুরু হতে পারে। কিন্তু বাংলায় নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনি দিয়ে কোনো শব্দ শুরু হতে পারে না। শব্দের শুরুতে ‘ঙখলা’ ধ্বনিক্রমটি বাংলায় গ্রহণযোগ্য নয়, যদিও ‘শৃঙ্খলা’য় আপত্তি নেই।
যত দ্যোতকই তৈরি করুক মানুষ, মানব-মস্তিষ্কে দ্যোতিতের সংখ্যা তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। দ্যোতিতের সংখ্যা বেশি কেন? এর একটি কারণ, পৃথিবীতে বস্তুর সংখ্যা অসীম। দ্বিতীয় কারণ, মানুষের মস্তিষ্ক নামক যন্ত্রে বিশেষ দু’টি মডিউলের উপস্থিতি। এই দু’টি মডিউলের মধ্যে একটির কাজ হবে ক-নামক উপাদান ও খ-নামক উপাদানের মধ্যে যোগ-বিয়োগ করা আর অন্যটির কাজ হবে ক-এর সাথে খ-এর সাদৃশ্য খুঁজে বের করা। প্রথম মডিউলটির নাম হতে পারে ‘কোয়ান্টিফায়ার’ (পরিগণক) মডিউল এবং দ্বিতীয়টির নাম হতে পারে ‘অ্যানালজি’ (যার বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে ‘অনুসার’) মডিউল। কম্পিউটার যেমন বিভিন্ন প্রোগ্রাম অনুসারে কাজ করে তেমনি মানুষের মস্তিষ্কেও বিভিন্ন প্রোগ্রাম রয়েছে। কোনো কোনো ভাষাবিজ্ঞানীর মতে (যাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন নোম চমস্কি) এসব প্রোগ্রাম মানব মস্তিষ্কে জন্মাবধি থাকে। অন্য কিছু পন্ডিতের মতে, জন্মের সময় শিশুর মস্তিষ্ক শুধুই একটি কম্পিউটার। বড় হতে হতে চারপাশের জীবন ও জগতের সাথে মিথস্ক্রিয়া বা ইন্টারঅ্যাকশন করে মস্তিষ্কে প্রোগ্রাম তৈরি হতে থাকে। একটি দু’টি নয়, হাজার রকমের প্রোগ্রাম রয়েছে মানুষসহ যে কোনো প্রাণীর মস্তিষ্কে। এক একটি প্রোগ্রাম এক একটি মডিউলের অংশ।
পরিগণক মডিউলের কাজ বস্তুর সংখ্যা গণনা করা। শুধু মানব মস্তিষ্ক নয়, এর চেয়ে অনেক কম উন্নত যেমন পাখির মস্তিষ্কেও এই পরিগণক মডিউল রয়েছে। যে কোনো পাখি একটি বিস্কিট আর দুইটি বিস্কিটের তফাৎ বোঝে। পরিগণক মডিউলের আবার বিভিন্ন উপমডিউল আছে যার মধ্যে একটির কাজ হচ্ছে যোগ করা: ‘ক’ দ্যোতিতের সাথে ‘খ’, ‘ক+খ’-এর সাথে ‘গ’…. ইত্যাদি। একে আমরা বলতে পারি ‘যোজনা’ উপমডিউল। অ্যানালোজি মডিউলের প্রধান একটি কাজ হচ্ছে কোনো একটি দ্যোতককে কমবেশি সাদৃশ্যপূর্ণ অন্য একটি দ্যোতিতের সঙ্গে য্ক্তু করা। একেবারে আনকোরা, নতুন একটি দ্যোতক সৃষ্টি করার চাইতে এ কাজটি সহজতর। ধরা যাক, একবার আগুনে হাত দিয়ে শিশুর হাত পুড়েছে। শিশু দ্বিতীয় বার আর হাত দেয় না. আগুনের ছবিতেও হাত দিতে চায় না, কারণ, মস্তিষ্কের অনুসার মডিউল শিশুকে বলে: ‘এটা আগুন, হাত দিলে আবার হাত পুড়বে।’ পুড়বেই এমন কোনো কথা নেই, তবুও অনুসার বা অ্যানালোজি মডিউল ধরে নেয়, হাত পুড়বেই যে কোনো আগুনে হাত দিলে, অর্থাৎ অনুসার মডিউল আগুনের দ্যোতিতটাকে আগুনের ছবিসহ আগুনের সব ধরনের দ্যোতকের উপর আরোপ করে।
রূপক শব্দ সৃষ্টিতে এই অনুসার মডিউলের ভূমিকা আছে বলে মনে হয়। ফরাসি ভাষায় যে প্রাণীটির নাম ‘সুরি’ বাংলায় তার নাম ‘নেংটি ইদুর’। বাঙালির ভাষা মানসে ‘নেংটি ইদুর’ এক ধরনের ইঁদুর বই নয়। বাংলায় যে প্রাণীর নাম ‘বাদুড়’ ফরাসিতে তার নাম ‘শোভসুরি’ বা ‘টেকো নেংটি ইদুর’। কিন্তু ফরাসি ভাষা মানুসে ইঁদুর আর নেংটি ইঁদুর দু’টি আলাদা প্রাণী। ‘সুরি’ শব্দে বাদুরের নামগন্ধ নেই। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বাদুড় প্রাণীটিকে ফরাসি ভাষামানস একটি ‘টেকো নেংটি ইঁদুর’ মনে করেছে যেমন করে বাংলা ভাষামানস এক ধরনের ‘সবুজ রঙের লাফিয়ে চলা পোকা’র নাম দিয়েছে ‘সাপমাসী’। ফরাসিতে এই একই পোকার নাম ‘সতরেল’ অর্থাৎ ‘লাফিয়ে চলা ছোট কোনো কিছু’। বাংলা শব্দটিতে পোকাটির স্বভাবের কোনো প্রতিফলন নেই কিন্তু ফরাসি ‘সতরেল’ শব্দে পোকাটির একটি বিশেষ স্বভাব ‘লাফানো’ প্রতিফলিত হয়েছে। এভাবে একটি দ্যোতিতের বৈশিষ্ট্য অন্য একটি দ্যোতিতের উপর আরোপ করে মানব মস্তিষ্কের অনুসার মডিউল নতুন দ্যোতক সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। অনুসার আর যোজনা মডিউলের কারণে একটি দ্যোতিতের সাথে অন্য একটি দ্যোতিত যোগ হয়ে নিত্যনূতন সঙ্কেতের সংখ্যা অবিরাম বেড়ে চলে। সাপ + মাসি = সাপমাসি, শোভ (‘টেকো’) + সুরি (‘নেংটি ইঁদুর’) = শোভসুরি ইত্যাদি।
কবিদের মস্তিষ্কে এই অ্যানালজি মডিউলটি সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি ক্রিয়াশীল থাকে। ‘উপমাই কবিতা’ কথাটি বলেছিলেন হাজার দু’য়েক বছর আগে অ্যারিস্টটল আর ইদানিং কালে বাঙালি কবি জীবনানন্দ। ধরা যাক, কবির মস্তিষ্কে সৃষ্টি হলো এক নতুন দ্যোতিত ‘পাখীর নীড়ের মতো চোখ’। যে চোখে পিচুটি পড়ে বা ছানি পড়ে ঝাপসা হয়ে যায় যে চোখ, সে রকম সাধারণ কোনো ‘চোখ’ নয় এই ‘পাখীর নীড়ের মত চোখ’। অন্য একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ‘মাঝি’ এক জিনিষ আর ‘মনমাঝি’ অন্য এক জিনিস। ‘মনমাঝি’ আপনাকে সদরঘাট থেকে জিঞ্জিরায় নিয়ে যেতে পারে না বা পিঞ্জিরার ‘মনপাখি’কে ছোলা খাওয়ানোও সম্ভব নয়। কবিদের এই সব নিত্যনতুন দ্যোতক যখন সাধারণ্যে গৃহীত হয় তখন নতুন দ্যোতক আর এর দ্যোতিতটি ভাষার অংশ হয়ে যায়।
রূপক শব্দেরও পরিবর্তন আছে। পরিবর্তন জীবনের ধর্ম। ভাষা জীবনের অংশ। সুতরাং ভাষাও স্বতঃপরিবর্তনশীল। এক সময় ‘বিদ্যালয়’ ছিল একান্তভাবে ‘বিদ্যার আলয়’। শিক্ষার্থীকে সেই আলয়ে বেশ কিছুক্ষণ বাস করতে হত। তুলনা করুন, ‘যমালয়’, ‘বেশ্যালয়’। প্রথম দিকে ‘বিদ্যালয়’ একটি রূপক শব্দ ছিল, এখন অতি সাধারণ একটি শব্দ। সংস্কৃতে ‘উদার’ শব্দটির অর্থ = দ্যোতিত ছিল ‘বৃহৎ উদর আছে এমন কোনো প্রাণী’ অর্থাৎ ঘোড়া। এটিও রূপক শব্দ এবং নিঃসন্দেহে কোনো না কোনো কবি শব্দটির শিলান্যাস করে থাকবেন সুদূর অতীতে। পরে শব্দটির পরিবর্তিত অর্থ দাঁড়ায়: ‘বৃহৎ হৃদয় আছে এমন কোনো ব্যক্তি’।
কবি যা খুশি কল্পনা করতে পারেন, কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে করেন না। মস্তিষ্কের অনুসার মডিউল অজ্ঞাত কিছু নিয়ম মেনে চলে। কোনো দু’টি ভাষাতেই উপমাসৃষ্টি একভাবে হয় না। ভারতবর্ষে সুন্দরী নারীর মুখের সঙ্গে চাঁদের উপমা দেয়া হয়। এ উপমা ফরাসি সাহিত্যে পুরোপুরি অনুপস্থিত। সাধারণ বাঙালির প্রেমপত্রে ‘ময়নাপাখী’ বা ‘গোলাপ’ প্রেমিকার উপমা, কিন্তু সাধারণ ফরাসি প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের বিপরীত সঙ্গীকে সম্বোধন করে ‘মো শু’ (‘ওগো আমার বাঁধাকপি’) বা ‘মো কানার’ (‘ওগো আমার হাঁস’) বা ‘মা বিশ’ (‘ওগো আমার হরিণী’) বলে। বাংলা কবিতায় এ ধরনের উপমা ব্যবহার করা কোনো কবির পক্ষে সম্ভব নয়, যত মৌলিক আর আন্তরিকই সেই কবি হোন না কেন (যদিও ‘হরিণী’ চলতে পারে)। সুতরাং উপমাসৃষ্টির ব্যাপারটিও ভাষার নিয়মের অধীন।
ভাষার পুরো ব্যাপারটাই এক ধরনের মূর্তি নিয়ে খেলা। কোন মূর্তি ঠিক কোন জায়গায় বসবে তা ঠিক করে ভাষার ব্যাকরণ, উল্টাপাল্টা বসিয়েছেন কি মরেছেন। খেলা ভঙ্গ, পূজা প-। পূজাম-পে সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীদের হামলাও হয় অনেক সময়। যেমন আনন্দবাজারীরা লেখে: ১ বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারি। এটি ছোট খাট একটি হিন্দি-প্রভাবিত হামলা বাংলা ভাষার উপর। অনেক পূজারী নিজের ইচ্ছেমত মূর্তি সাজায়। এক দেবতার পূজার নিয়মে শুরু করেন তারা অন্য দেবতার পূজা। এর উদাহরণ: কবিতায় শ্রী মধুসূদন দত্ত বা গদ্যে কমলকুমার মজুমদার। কমলকুমার ফরাসি বাক্যবিন্যাসে বাংলা শব্দ সাজাতে চেষ্টা করেছেন। মূর্তির নতুন বিন্যাস যদি সবাই কমবেশি মেনে নেয় তবে সেটা হয়ে দাঁড়ায় নতুন স্টাইল। এর ফলে ভাষা সমৃদ্ধ হতে পারে। যদি পূজার নতুন এই পদ্ধতি কেউই মেনে না নেয় তবে তাকে বলা হয় অকারণ বিদ্রোহ। চোরাগোপ্তা হামলা আর অকারণ বিদ্রোহ ভাষা ব্যবহারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
সিনেমায়ও প্রতিমা ও প্রতীকের ব্যবহার হয়। চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’ ছবির একটি দৃশ্যে দেখা যায় শ্রমিকেরা কারখানায় ঢুকছে। পরের দৃশ্যে দেখানো হয় এক পাল ভেড়া ঢুকছে খোঁয়ারে। এখানে ভেড়ার পাল শ্রমিকের দলের রূপক। ‘আধুনিক যুগে শ্রমিকের সাথে ভেড়ার কোনো ফারাক নেই’− এই দ্যোতিতটি সৃষ্টি করেছে শ্রমিক ও ভেড়ার দ্যোতকের পর পর ব্যবহার। চলচ্চিত্রের ইংরেজি পরিভাষায় দ্যোতিত সৃষ্টির এই বিশেষ টেকনিকটির নাম ‘মন্তাজ’। চিত্রশিল্পেও প্রতিমা ও প্রতীকের বহু বিচিত্র ব্যবহার লক্ষ্য করা যেতে পারে।
চিহ্নবিজ্ঞান বা সেমিওলজি
প্রতিমা, প্রতীক, সঙ্কেত সহ যাবতীয় চিহ্নের বর্ণনা ও ব্যাকরণ ‘সেমিওলজি’ নামক বিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়। গ্রীক শব্দ ‘সেমেইয়ন’ আর ‘লোগোস’ সমাসবদ্ধ হয়ে এই শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে। ‘সেমিওলজি’ শব্দটি ১৭৫২ সাল থেকেই ফরাসি ভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে। তখন সেমিওলজি ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের অংশ। সে যুগে এর কাজ ছিল, রোগের উপসর্গ দেখে রোগ নির্ণয় করা। উপসর্গগুলো রোগের লক্ষণ বা চিহ্ন। জ্বর হলে যেহেতু গায়ে ব্যথা করে সেহেতু গায়ে ব্যথা ব্যথা করলে ভাবতে হবে জ্বর হয়েছে…. ইত্যাদি। ১৯১০ সালে সুইস ভাষাবিজ্ঞানী Ferdinand de Saussure (১৮৫৭-১৯১৩) এই শব্দটিকে চিহ্ন বিজ্ঞানের প্রতিশব্দ হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেন। উত্তর আমেরিকান ঘরানায় এই শাস্ত্রের নাম ‘সেমিওটিকস্’। উত্তর আমেরিকায় সেমিওটিকসের গোড়াপত্তন করেন Charles Sanders Peirce (১৮৩৯-১৯১৪)। সস্যুর আর পার্সের মতে সমাজে চিহ্নসমূহের উদ্ভব, বিকাশ ও বিন্যাস বিচার-বিশ্লেষণ করবে যে শাস্ত্রটি তারই নাম হবে ‘সেমিওলজি’ বা ‘সেমিওটিকস্’। ভাষা চিহ্নের সমষ্টি। সুতরাং একদিক থেকে দেখলে ভাষাবিজ্ঞান সেমিওলজি বা চিহ্নবিজ্ঞানেরই একটি শাখা (ফরাসি সেমিওলগ বা ‘চিহ্নবিজ্ঞানী’ Roland Barthes এই মতই পোষণ করতেন)।
তবে চিহ্নবিজ্ঞান ও ভাষাবিজ্ঞানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি পার্থক্য আছে। আগেই বলা হয়েছে সব ধরনের চিহ্ন দিয়ে ভাষা সৃষ্টি হয় না। ভাষা সৃষ্টি করার জন্য প্রয়োজন ‘সঙ্কেত’ জাতীয় চিহ্নের। একাধিক সঙ্কেত একত্রিত হয়ে ভাষা সৃষ্টি হয়। অন্যান্য চিহ্নের সাথে সঙ্কেতের পার্থক্য দু’টি ক্ষেত্রে: ১. সঙ্কেতের ক্ষেত্রে দ্যোতক ও দ্যোতিতের সম্পর্ক আর্বিত্রিক; ২. সব ধরনের চিহ্নেরই পারষ্পরিক অবস্থান বা বিন্যাস (Syntactic) থাকতে পারে কিন্তু সঙ্কেতের ক্ষেত্রে চিহ্নসমূহের বিন্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং ‘সঙ্কেত’ চিহ্ন হলেও এটি বিশেষ এক ধরনের চিহ্ন এবং সঙ্কেতের সমষ্টি যেহেতু ভাষা সেহেতু ভাষাবিজ্ঞানকে সেমিওলজির শাখা না বলে একে স্বতন্ত্র একটি বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করার যুক্তিযুক্ত।
বিমূর্ত ধারণা ও ঈশ্বর
‘কলা’ দ্যোতকটির একটি সর্বজনপরিচিত নির্দেশিত আছে। মোটা মোটা আঙুলের মতো হলুদ রঙের এই ফলটি আমরা সবাই চিনি। বাস্তব জগতের একটি ফল হচ্ছে এই কলা। কিন্তু অনেক দ্যোতক যেমন ধরুন, ‘ভালোবাসা’ বা ‘জনগণ’-এর কোনো নির্দেশিত নেই। এসব শব্দের শুধু দ্যোতক ও দ্যোতিত রয়েছে। নির্দেশিত বা রেফারেন্ট নেই এমন শব্দকে বলা হয় বিমূর্ত শব্দ। বিমূর্ত শব্দ নিয়ে হাজারো ঝামেলা। যা আমার জন্য ‘কলা’ তা দুনিয়ার সবার জন্য ‘কলা’। কিন্তু আমি যে অনুভূতিটিকে ‘ভালোবাসা’ বলে মনে করি সেই একই অনুভূতিকে আপনি হয়ত ‘ভালোবাসা’ বলে মনে করেন না।
এ রকম আর একটি বিমূর্ত শব্দ ‘ঈশ্বর’। দেশে দেশে ঈশ্বরের হাজার রকম চেহারা। সমভূমির ঈশ্বর আর মরুভূমির ঈশ্বরের প্রকৃতি এক রকম নয়। ভারতবর্ষের যমুনাতীরের ‘কাউবয়’ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গরুর গায়ে হেলান দিয়ে বাঁশি বাজাতে পারেন পরের বৌ, নিজের গার্লফ্রেন্ড রাধাকে জড়িয়ে ধরে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এ ধরনের ঈশ্বরকে পত্রপাঠ ‘কতল’ করা হবে। ইওরোপীয় দেশগুলোতে এরকম ঈশ্বরের ভিসা পাওয়াই মুশকিল হবে, পূজা পাওয়া তো অনেক দূরের কথা।
ঈশ্বরের রূপ কেমন? ধর্মগুলোর উত্তর: তাকে কল্পনা করা যায় না। তার রূপ কল্পনা করতে গেলে নাকি ‘বাক্যের সহিত মন ফিরিয়া আসে’। ঈশ্বরের রূপ কল্পনা করা না গেলেও তার গুণগুলোর কথা আমরা সবাই জানি। ঈশ্বরে যাঁরা বিশ্বাস করেন তাঁদের মধ্যে খুব কম লোকেরই এ ব্যাপারে সন্দেহ আছে যে ঈশ্বরই মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী সৃষ্টি করেছেন। তিনি ধর্মগ্রন্থসমূহ রচনা করেছেন। তিনি মানুষকে পাপ ও পুণ্যের বোধ দিয়েছেন। পুণ্য করলে মানুষকে তিনি পাঠিয়ে স্বর্গে আর পাপ করলে সোজা নরকে। যখন মানুষের পাপ-পুণ্যের বোধ লোপ পায় তখন (মধ্যপ্রাচ্যে প্রচলিত ধর্মমত অনুসারে) তিনি নবী পাঠিয়ে দেন পৃথিবীতে অথবা (ভারতবর্ষে প্রচলিত হিন্দু ধর্ম অনুসারে) নিজেই চলে আসেন পৃথিবীতে। লক্ষ্য করা যেতে পারে যে এই ‘আসা-যাওয়া’, ‘পাঠানো’-র মতো ঈশ্বরের অনেকগুলো গুণ মানুষেরও আছে। মানুষ আইন রচনা করতে পারে। কোনো মানুষ আইন না মানলে তাকে পাঠানো হয় জেলখানায়। আইন সব সময় মেনে চললে তাকে কোনো পুরস্কার অবশ্য দেয়া হয় না। তবে খুব ভালো কোনো কাজ করলে তাকে পুরস্কার দেয়া হয়: নোবেল, অস্কার, পদ্মশ্রী, একুশে পুরস্কার ইত্যাদি। এ রকম দাবি করা যেতে পারে যে যোজনা উপ মডিউলের প্রভাবে মানুষের বিভিন্ন গুণ যোগ হয়ে মানব মস্তিষ্কে তৈরি হয়েছে ঈশ্বরের রূপক।
ঈশ্বর ধারণায় অ্যানালজি বা অনুসারের প্রভাব লক্ষ্যনীয়। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। তিনি সব দেখেন। মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের এটি একটি বড় তফাৎ। মানুষ সব দেখে না। একজন মানুষ যখন মন্ট্রিয়লে আছে তখন সে একই সাথে চট্টগ্রামে থাকতে পারে না। ঈশ্বর কিন্তু পারেন। সুতরাং ‘ঈশ্বর যখন পৃথিবীতে আসেন তখন স্বর্গে কে থাকে?’− এ ধরনের প্রশ্ন করা যাবে না, কারণ তিনি একই সাথে সব জায়গায় থাকতে পারেন। সর্বত্র বিরাজমান হওয়ার গুনটি অভূতপূর্ব মনে হতে পারে মানুষের কাছে, কারণ মানুষের এ গুণটি নেই। কিন্তু যৌক্তিকভাবে চিন্তা করলে এটা অসম্ভব নয়। ‘ক’ যদি এক জায়গায় থাকতে পারে তবে সব জায়গায় থাকতে অসুবিধা নেই, কারণ সব জায়গা হচ্ছে অনেকগুলো এক জায়গার সমষ্টি। মানুষ কোনো নির্দিষ্ট সময়ে শুধু একটি মাত্র স্থানে থাকতে পারে। অতিমানব ঈশ্বর সব জায়গায় থাকতে পারেন।
পৃথিবীর সব ধর্মের প্রধান গ্রন্থে ঈশ্বরের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সব ধর্মগ্রন্থকেই এক সময় ঈশ্বরের বাণী বলে মনে করা হত। এখনও অনেক ধর্মালম্বীর দৃঢ় বিশ্বাস: অন্ততপক্ষে তাদের ধর্মগ্রন্থটি মানব-রচিত হতে পারে না, অন্য ধর্মের গ্রন্থগুলো মানুষের লেখা হলেও হতে পারে। মানুষ কর্তৃক লিখিত হোক না হোক, ধর্মগ্রন্থগুলো মানব ভাষায় লেখা। মানবভাষা মানব মস্তিষ্কের সৃষ্টি। মানব ভাষার নিজস্ব কিছু প্রতিবন্ধ আছে। যেমন, এমন কিছু মানব ভাষায় প্রকাশ করা যায় না যা মানুষ কখনও দেখেনি বা শোনেনি। গ্রীক পুরাণের অশ্বমানব সেন্টরের উত্তমাঙ্গ মানুষের মতো, শরীরের বাকি অংশ ঘোড়ার মতো। ছাগমানবের পায়ে রয়েছে ছাগলের মত খুর। হিন্দুদের দেবতা গণেশের মুখ নেই, আছে হাতির মতো শুঁড়। মহিষাসুর নামক অসুরের মাথা ছিল মহিষের মতো। আগের দিনের মানুষের এসব কল্পনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মানুষ তার দেখা দু’টি আলাদা প্রাণীকে কল্পনায় জোড়া দিয়েছে। এটা মস্তিষ্কের যোজনা মডিউলের কাজ। মানুষ যখন ‘সোনার পাহাড়’ কল্পনা করে তখন সে নতুন কিছুই সৃষ্টি করে না। সোনাও সব মানুষ চেনে, পাহাড়ও সবাই দেখেছে। সুতরাং ‘সোনার পাহাড়’-এর রূপকটি বুঝতে কোনো মানুষেরই কোনো অসুবিধা হয় না। যে কোনো রূপক কল্পনায় যেমন ধরুন, ‘মনমাঝি’, ‘পাখির নীড়ের মতো চোখ’ ইত্যাদিতে উপমান ‘মন’, ‘পাখির নীড়’ আর উপমিত ‘মাঝি’, ‘চোখ’ মানুষের পূর্বপরিচিত হতেই হয়। অন্যথায় রূপক সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না কোনো কবির পক্ষেই।
আপনারা কি কখনও অন্য গ্রহের প্রাণী ই.টি.’র ছবি দেখেছেন? কিম্ভুতকিমাকার তার চেহারা: লম্বা কান, বামনের মতো আকার, সব মিলিয়ে বিচ্ছিরি ধরনের একটি মানুষ। মানুষ ই.টি.কখনও দেখেনি। ই.টি’র কল্পনা করার সময় মানুষ নিজের শরীরের একটি প্রতিরূপ তৈরি করেছে। কেন এই বিশ্রী প্রতিরূপ? আধুনিক মানুষ হয়তো চায় ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে সুন্দর প্রাণীটি একমাত্র সে নিজেই হবে। অন্য গ্রহের প্রাণী গুণে বা ক্ষমতায় মানুষকে ছাড়িয়ে গেলেও রূপে মানুষের তুলনায় সব সময় ন্যূন থাকবে, অন্তত মানুষের দৃষ্টিতে। ঈশ্বর প্রসঙ্গে মানুষের কিন্তু এমন কোনো ঈর্ষা নেই। হিন্দু দেবদেবীর মূর্তিই দেখুন বা গ্রীক দেবদেবীর মূর্তিই দেখুন, মানুষের কল্পনায় ঈশ্বরও সাধারণত হয়ে থাকেন সুন্দরতম পুরুষ বা নারী।
ঈশ্বর ও মূর্তিপূজা
পরিগণক মডিউলের কারণে মস্তিষ্ককে গুণতে হয়। গুণতে হলে অবয়ব বা মূর্তি চাই। বিমূর্ত জিনিস গোনা যায় না। ‘পানি’ বস্তুটি গোনা যায় না বলে মানুষ বলে: এক ‘গ্লাস’ পানি বা এক ‘বিন্দু’ জল। এখানে ‘গ্লাস’ আর ‘বিন্দু’ দিয়ে পানিকে অবয়ব দেয়া হলো। দুধের স্বাদ মানুষ ঘোলে মেটায়। নির্দেশিত নেই? কুচ পরোয়া নেই, কল্পনা করো। বানিয়ে নাও মনে মনে বস্তুটিকে। মানব মস্তিষ্ক বিমূর্ত ভাব সহ্য করতে পারে না। গ্রীকরা কল্পনা করেছিল ভালোবাসার এক দেবীকে। আর্য্যরা কল্পনা করেছিল ভালোবাসার দেবতা মদনকে। হাতে তার পঞ্চ শর। এদিক ওদিক ছুঁড়েই চলেছে তীরগুলো আর তাতেই নারীপুরুষ একে অন্যের প্রেমে পড়ছে। আধুনিক কালেও তীরবিদ্ধ তিনকোণা হৃৎপিন্ড ভালোবাসার প্রতীক।
মানুষের ঈশ্বর কল্পনার মূলেও রয়েছে মানবমস্তিষ্কে মূর্তির অত্যাবশ্যকতা। মূর্তি ছাড়া মস্তিষ্কের কাজ চলে না। নাড়– হাতে হামাগুড়ি দেয়া শিশু, হনুমান, গরু, বৃক্ষ, মায়ের কোলে শিশু, ক্রস, আকাশের তারা, বাঁকানো চাদ, জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকা (রাধাকৃষ্ণ), নারীপুরুষের গোপনাঙ্গ (শিবলিঙ্গ) ইত্যাদি কতরকম মূর্তিই না মানুষ কল্পনা করেছে ঈশ্বরের। এমন কোনো ধর্ম নেই যেটিতে কোনো না কোনো ফর্মে মূর্তিপূজা নেই। মূর্তি ছাড়া পূজা বা প্রার্থনা কোনোটাই করা যায় না। মূর্তি দুই রকম হতে পারে: বাস্তব মূর্তি ও ভাবমূর্তি। বাস্তব মূর্তি হিন্দু ধর্মে ‘প্রতিমা’ নামে পরিচিত (এর সাথে সেমিওলজির অধিশব্দ ‘প্রতিমা’-র পার্থক্য আছে)। দেবতার বাস্তব মূর্তি বা ভাবমূর্তি এই দুটি’র কোনোটিরই নির্দেশিত নেই। বাস্তবে দুর্গা, কালী বা গণেশের অস্তিত্ব আছে এমনটি প্রমাণ করা কঠিন।
বাস্তব মূর্তির সাথে ভাবমূর্তির তফাৎ আছে। ভাবমূর্তির শুধুই দ্যোতিত আছে, কোনো নির্দেশিত নেই। কেউ জানে না, বাংলাদেশের ভাবমূর্তির নির্দেশিতটি দেখতে কেমন। কিন্তু এই ভাবমূর্তি যে আছে তার প্রমাণ এই যে প্রায়ই বাংলাদেশের সরকারী দলের মুখপাত্রদের বক্তব্যে বিরোধীদল কর্তৃক দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার অভিযোগ শোনা যায়। মৌলবাদীরা যেমন মাঝে মাঝে হিন্দুমন্দিরে দেবমূর্তি ভাঙে তেমনি দেশের তথাকথিত ‘শত্রুরা’ (প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবরের shatrus) হরহামেশা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে। নষ্ট হওয়ার কথা যখন উঠছে তখন এটা নিশ্চিত, মূর্তিটিও আছে কোথাও না কোথাও। সরকার মাটি পাথরের মূর্তির জন্য ততটা উদ্বিগ্ন হয় না। কিন্তু নিদারুণ বিচলিত হয় ভাবমূর্তির জন্য। ভাবমূর্তি ভাঙছে বলে যাদের সন্দেহ হয় যেমন, মুনতাসীন মামুন, শাহরিয়ার কবির প্রমুখদের অনেক দিন কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় দেশের ভাবমূর্তিকে অটুট রাখার জন্য। প্রাচীন গ্রীক জাতি বা বর্তমানের হিন্দু ধর্মালম্বীরা যদি মূর্তির জন্য দরদ দেখায় তবে তার একটা অর্থ হয়। কিন্তু ইসলামে মূর্তিপূজা সর্বতোভাবে নিষিদ্ধ। মুসলিমপ্রধান এই বাংলাদেশে একটা ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য এই অতি ব্যস্ততার কারণ কি? সমাজমনের অবচেতনে বয়ে যাওয়া হিন্দু-বৌদ্ধ অতীতের অনুৎঘাটিত কোনো শেকড় এই মূর্তিরক্ষাজনিত উৎকন্ঠার কারণ কিনা সমাজমনোবিজ্ঞানীরা আশা করি তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন।
এখন ‘অফিসিয়ালি’ একমাত্র হিন্দুরাই মূর্তিপূজা করে। গ্রীক-রোমান আর আরবেরা আগে মূর্তিপূজা করত, এখন ছেড়ে দিয়েছে। অবশ্য খ্রীষ্টধর্ম আর বৌদ্ধধর্মে এখনও যীশু ও বুদ্ধের একধরনের মূর্তিপূজা চালু আছে। একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোতে যখন ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয় তখন মূর্তি ব্যবহার করা না হলেও প্রার্থনাকারীর মস্তিষ্কে কোনো না কোনো ভাবমূর্তি অবশ্যই সৃষ্টি হয়। সেই ভাবমূর্তি মানুষেরই মতো মানুষের প্রার্থনা শুনে দয়াপরবশ হয়। এই ভাবমূর্তিই সব দেখেন, সব জানেন, সব বোঝেন। ‘জানা’, ‘বোঝা’ বা ‘দেখা’র মতো জৈবিক বা মানবিক গুণগুলো আরোপ করে সেই ভাবমূর্তি গঠিত হয়। ‘ভালবাসা’ বা ‘সৌন্দর্যের মতো বিমূর্ত ধারণার ক্ষেত্রে যেমন হয়, তেমনি এই ভাবমূর্তির অবয়বও জনে জনে আলাদা হতে পারে।
এ রকম ঘটতে বাধ্য, কারণ মানব মস্তিষ্ক একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। যে কোনো যন্ত্রের ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া তার নিজস্ব মডিউলগুলোর উপর নির্ভর করে। এছাড়া যে কোনো কম্পিউটার জাতীয় যন্ত্র ডাটা বা প্রদত্ত তথ্য নির্ভর। ইনপুটে যা যা আছে তার উপরই নির্ভর করবে এর আউটপুট। সুতরাং মানবভাষায় যে ঈশ্বরের বর্ণনা দেয়া সম্ভব বা ধর্মগ্রন্থগুলোতে যে ঈশ্বরের বর্ণনা আছে তা একান্তই মানুষের অভিজ্ঞতা ও কল্পনার জোড়াতালি দেয়া একটি চিত্র। এর অন্যথা হওয়া কার্যত অসম্ভব। যতক্ষণ মস্তিষ্ক আছে, ততক্ষণ ঈশ্বরও আছেন। মস্তিষ্ক যে মুহূর্ত থেকে নেই সেই মুহূর্ত থেকে ঈশ্বরও নেই।
আপনারা হয়তো বলবেন, ‘মানলাম’ ঈশ্বর মানুষের মস্তিষ্কের সৃষ্টি, কাল্পনিক একটি মূর্তি বা ছবি। তাতে কি প্রমাণ হলো যে ঈশ্বর নেই? না, তা নয়। আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই মানুষের মস্তিষ্ক যে ঈশ্বরকে কল্পনা করে বা করতে পারে সেই ঈশ্বর আছে কি নেই সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা অসম্ভব। যেমন আমরা বলি, অন্য গ্রহে প্রাণী আছে। কিন্তু আদৌ প্রাণী আছে কিনা, বা সেসব প্রাণীকে আদৌ ‘প্রাণী’ বলা যাবে কিনা − এ ব্যাপারে নিশ্চত করে কিছু বলা মানুষের সাধ্যের বাইরে। সোনা আছে, পাহাড়ও আছে, সোনা আর পাহাড় মিলিয়ে ‘সোনার পাহাড়’ মানুষ কল্পনা করে কিন্তু ‘সোনার পাহাড়’ এখনও পর্যন্ত কোথাও আবিষ্কৃত হয়নি। হাতি-ঘোড়া আছে, মানুষও আছে কিন্তু ‘হাতি-মানুষ’ (গনেশ) বা ‘ঘোড়া-মানুষ’ (গ্রীক পুরাণের সেন্টর) আছে কি নেই তা আমরা জানি না। ‘অকল্পনীয়’, ‘অচিন্তনীয়’ যে ঈশ্বরের কথা আমরা শুনি মানুষের মস্তিষ্ক তাকে ধারণ করতে পারে না। মানুষ যার কথা ভাবতে পর্যন্ত পারে না কিভাবে তাকে বর্ণনা করবে মানুষ? তাঁর কাছে প্রার্থনা করে কি হবে − তিনি কি মানুষ যে প্রার্থনায় তৃপ্ত হবেন? সুতরাং যে ঈশ্বরের কথা আমরা বহু যুগ ধরে শুনে আসছি তিনি থাকলেই বা কি, না থাকলেই বা কি। এ বছর কোন ছবি অস্কার পেল তাতে অন্ধের কি যায় আসে?
ঈশ্বর ও সংখ্যা
ঈশ্বর কি বিমূর্ত ধারণা? বিমূর্ত অবশ্যই তবে বিমূর্ততারও বিভিন্ন রকমফের আছে। ‘ভালোবাসা’ ‘সৌন্দর্য’ বা ‘ঈশ্বর’ এ সবই বিমূর্ত ধারণা কারণ এসব চিহ্নের কোনো রেফারেন্ট বা নির্দেশিত নেই, কিন্তু মস্তিষ্কে দ্যোতকগুলোর দ্যোতিত আছে। মস্তিষ্কের বিশেষ একটি অনুভবের নাম ‘ভালোবাসা’। মস্তিষ্কে অনুভূত বিশেষ একটি ‘গুণ’-এর নাম সৌন্দর্য। কিন্তু এসব অনুভব বা বোধ সর্বত্র বিরাজমান নয়। আপনার চারপাশে ভালোবাসা বা সৌন্দর্য ছড়িয়ে নেই। সেখানে ঘৃণা আছে, বিশ্রীভাব আছে। ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান। ঈশ্বর যদি সর্বত্র বিরাজমান না হন তবে তার পক্ষে অস্তিত্ববান হওয়া অসম্ভব, কারণ সেক্ষেত্রে এমন কিছু স্থান থাকবে যেখানে ঈশ্বর থাকবেন না। যদি ব্রহ্মা-ের কোনো একটি জায়গায়ও ঈশ্বর না থাকেন তবে মস্তিষ্কের অ্যানালজি মডিউল সব জায়গায় তার অনস্তিত্বের দিকে ইঙ্গিত করতে পারে।
ঈশ্বরের সর্বত্র বিরাজিত থাকার ব্যাপারটা মেনে নেওয়া যায় যদি মানুষের বোধের আওতায় ঈশ্বর ছাড়াও অন্তত অন্য একটি ধারণা থাকে যেটি সর্বত্র বিরাজমান। আছে তেমন একটি জিনিষ। জিনিষটি হচ্ছে ‘সংখ্যা’। সৃষ্টির কোথাও আপনি ১, ৩, ৫ সংখ্যাগুলো দেখাতে পারবেন না। অথচ আপনার চারপাশে যে দিকেই তাকান সেদিকেই সংখ্যার ছড়াছড়ি। আপনার বাঁদিকে ৫টি চেয়ার, ডানদিকে ৩টি জলের গ্লাস, সামনে সুন্দর ১টি মেয়ে বা ছেলে আর পেছনে একাধিক শত্রু। যেখানে কিছু নেই সেখানে আছে ০ শূন্য। সংখ্যার এইসব সঙ্কেত আবিষ্কৃত হয়েছিল ভারতে, পরে আরবদের হাত দিয়ে সেগুলো পৌঁছায় ইউরোপে। গ্রীকরা আর রোমানরাও সংখ্যা সঙ্কেত II, V, X, C, L আবিষ্কার করেছিল কিন্তু কোনো কাজের ছিল না সেগুলো। গ্রীক-রোমান দেবদেবীর মতো গ্রীক-রোমান সংখ্যাসঙ্কেতগুলো আজ ইতিহাসের অংশ। ভাষায় রোমান সংখ্যার ব্যবহার আজকের যুগে অনেকাংশে আলঙ্কারিক। সংখ্যার প্রধান ব্যবহার যে গণিত তাতেই রোমান সংখ্যার ব্যবহার নেই। ভারতবর্ষে সংখ্যাসঙ্কেতগুলো (পশ্চিমে যেগুলো ‘আরবীয় সংখ্যা’ নামে পরিচিত) উদ্ভাবিত না হলে আধুনিক গণিতের এত উন্নতি আদৌ হত কিনা সে ব্যাপারে সন্দেহ করা যেতেই পারে।
আপনারা হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন, সংখ্যাকে কেন ‘প্রতীক’ না বলে ‘সঙ্কেত’ বলছি। এগুলো প্রতীক নয় কারণ প্রথমত দ্যোতক ১-এর সাথে মানবমস্তিষ্কে সৃষ্টি হওয়া দ্যোতিত ‘এক’-এর যে সম্পর্কটি আছে সেটি একান্তই কাকতালীয় বা আর্বিত্রিক। এই আর্বিত্রিকতা সঙ্কেতের একটি প্রধান লক্ষণ। দ্বিতীয়ত অন্য যে কোনো সঙ্কেতের মতো, সংখ্যার ক্ষেত্রেও সিন্টাক্টিক বা বিন্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১-এর ডান পাশে ০ বসান, ০ এবং ১ উভয়েরই মূল্য বাড়বে। ১-এর বাম দিকে শূন্য বসিয়ে দেখুন, ০ এবং ১ কারও মূল্যই এতটুকু বাড়বে না। পারষ্পরিক অবস্থান যখন এতই গুরুত্বপূর্ণ তখন সংখ্যাগুলো সঙ্কেত না হয়ে যায় না।
সংখ্যার এই বোধ যদি সত্য হয় তবে ঈশ্বরের বোধটিও সত্য হতে বাধা নেই। ‘ঈশ্বর নেই’− এটা প্রমাণ করা যাবে না। এক রকম বাঁচিয়ে দিলাম ‘দাদু’কে (আমার বাপের বাপ ঠাকুরদা’ আর মায়ের বাপ দাদু দু’জনের নামই ছিল ‘ঈশ্বর’)। তার মানে কি তিনি আছেন? ‘আছেন’ বললেই তো ঈশ্বরের নাতিকে আপনারা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলবেন। ‘ঈশ্বর কি স্বর্গে আদমকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাচার করার ক্ষমতা রাখেন?’, ‘ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হয়ে থাকেন তবে দড়িতে এমন কোনো গিঁট কি তিনি দিতে পারেন যা তার নিজেরও খোলার ক্ষমতা নেই?’, ‘ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলে কি আমার অমুকের আমেরিকার ভিসা হবে? ‘ঈশ্বরের কি অতীতকাল পরিবর্তন করার কোনো ক্ষমতা আছে?’ ‘আচ্ছা ঠিক আছে, একটা প্রশ্নের উত্তর দিন শুধু: ঈশ্বর কি সব দেখেন?’
এত সব ভুল প্রশ্নের কি জবাব দিই বলুন। যতই হই না কেন ঈশ্বরের নাতি, আমার ‘নব সংখ্যা দর্শন’ (?)-এর ক্ষমতারওতো একটা সীমা আছে। আপনাদের প্রশ্নগুলোতে মানুষের যাবতীয় গুণ, এই যেমন ধরুন, ‘পাচার করা’, গিঁট খোলা’, ‘সব দেখা’… আপনারা ঈশ্বরের উপর আরোপ করছেন। ঈশ্বর কিছুই দেখেন না, কাউকে কোথাও পাঠান না তিনি। পাঠাতে পারেন কি পারেন না, সব দেখার ক্ষমতা আছে কি নেই − এসব প্রশ্ন অবান্তর। আচ্ছা, আমি যদি বলি, আমাদের ভুলো কুকুরটা ওদের পুসি বিড়ালটাকে ই-মেল করেছে, তবে কি আপনি অবাক হন? নিশ্চয়ই হন, কারণ আপনি ভালো করেই জানেন ভুলো বা পুসির পক্ষে ইলেক্ট্রনিক মেলামেশা সম্ভব নয়। ‘ভুলো’, ‘পুসি’ বা ‘ঈশ্বর’ এরা কেউই মানুষের ক্যাটাগরিতে পড়েন না। সুতরাং মানুষের গুণাবলী এদের কারও মধ্যেই থাকবে না − এটাই স্বাভাবিক। ঈশ্বর সৃষ্টির কর্তা কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর। সৃষ্টিশীলতা মানুষের স্বভাবগত একটি গুণ। আমরা বলেছি, মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর এই গুণটি নেই। যখনি মানুষ ঈশ্বরকে ‘সৃষ্টিকর্তা’ বলে তখনি নিজের সৃষ্টিশীলতার গুণটি সে ঈশ্বরের উপর আরোপ করে।
চলবে—
প্রথম পর্বের লিংক: http://www.bdsfbd.com/archives/947
দ্বিতীয় পর্বের লিংক: http://www.bdsfbd.com/archives/950
The post সেমিওলজি ও ঈশ্বর – তৃতীয় পর্ব appeared first on Bangladesh Study Forum.
লেখক, সমালোচক ও ভাষাতাত্ত্বিক শিশির ভট্টাচার্য্যের গুরুত্বপূর্ণ বই ‘ঈশ্বর ধর্ম বিশ্বাস’ এর প্রথম অধ্যায় ‘সেমিওলজি ও ঈশ্বর’ এর শেষ অংশ নিচে দেওয়া হলো:
দেবতা ও ঈশ্বর: ধ্রুপদ ও খেয়াল
সাম্প্রতিক জিন গবেষণায় আবারও প্রমাণিত হয়েছে যাবতীয় বৈষম্য সত্ত্বেও পৃথিবীর সব মানুষ একই প্রজাতির সদস্য। গবেষণা হয়েছে এমন একটি জাতি নিয়ে যেটি নিজেদের সবচেয়ে অমিশ্রিত বলে মনে করত এতদিন। জাতিটি হচ্ছে জাপানি। জাপানিদের পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে জাপানিদের মধ্যে খাঁটি জাপানি আছে মাত্র ৪% ভাগ। বাকি ৯৬% ভাগ জাপানি নাগরিক চীনা ও কোরীয় বংশোদ্ভূত। পৃথিবীর সব মানুষ যেহেতু এক, সব মানুষের মস্তিষ্কের গঠনও মোটামুটি এক। জন্মের পর পারিপার্শ্বিকতার সাথে মিথষ্ক্রীয়ার কারণে ভাষা ও সংস্কৃতির মতো মানুষের মানসিক কাঠামোও এক এক দেশে এক এক রকম হয়ে যায়। কিন্তু যেহেতু মানুষের মস্তিষ্ক এক, সেহেতু ভাষা-ধর্ম-সংস্কৃতিতে মিলও থাকে অনেকখানি। মিল অবশ্যই আছে। পৃথিবীর ভাষাগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক মিল না থাকলে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ সম্ভব হত না।
মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী নোম চমস্কি বিশ্বব্যাকরণের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। এই বিশ্বব্যাকরণের দু’টি অংশ: ১. প্রিন্সিপাল যার বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে ‘ধ্রুপদ’, আর ২. প্যারামিটার যার বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে ‘খেয়াল’। চমস্কি মনে করেন, পৃথিবীর সব ভাষার ব্যকরণের ধ্রুপদ অংশটুকু এক। শুধু খেয়াল অংশের পার্থক্যের কারণে বিভিন্ন ভাষার ব্যাকরণ আলাদা হয়। চমস্কির ধ্রুপদ ও খেয়াল শুধুমাত্র ভাষার দ্যোতক অংশের জন্য প্রযোজ্য। দ্যোতিত অংশে কি ঘটে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে তিনি রাজি নন। ভাষার দ্যোতিত অংশেও ধ্রুপদ ও খেয়ালের অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব নয়। আর্থ ধ্রুপদের অস্তিত্বের কারণেই সম্ভবত এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদ সম্ভব হয়। সব ভাষাবিজ্ঞানী অবশ্য এ ধরনের সম্ভাবনার ব্যাপারে নিঃসন্দেহ নন।
চমস্কিকে অনুসরণ করে আমরা বলতে পারি, ঈশ্বর হচ্ছে মানুষের সমাজব্যবস্থায় সৃষ্টি হওয়া একটি ধ্রুপদ। সব সমাজে সব কালে ঈশ্বর ছিল। কিন্তু ভাষার মতোই ঈশ্বরের রূপ আর ধর্মের স্বরূপ এক রকম হতে পারেনি, কারণ সব কালে ও সব দেশে পারিপার্শ্বিকতার সাথে মানব মস্তিষ্কের মিথস্ক্রিয়া সমান হয়নি। সুতরাং ঈশ্বর ধারণার ধ্রুপদ অংশটুকু সব সমাজে কমবেশি এক, কিন্তু এই ধারণার খেয়াল অংশটুকু আলাদা। এ কারণে সব সমাজের সব ধর্মের ঈশ্বরের খেয়ালখুশি বা আচরণও এক রকম নয়। ধ্রুপদ ঈশ্বরকে আমরা বলতে পারি ‘ঈশ্বর’ আর খেয়াল ঈশ্বরকে বলা যেতে পারে ‘দেবতা’। ‘দেবতা’ বা ভাবমূর্তির রূপ আলাদা। ধরা যাক, প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্কে আলাদা আলাদা দেবতার সৃষ্টি হয়।
সুইস ভাষাবিজ্ঞানী ফার্দিন দ্য সস্যুর ভাষাকে দুই ভাগে ভাগ করেছিলেন। ব্যষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ভাষা জনে জনে আলাদা। আমরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা বাংলা বলি। প্রত্যেক ব্যক্তির এই যে আলাদা আলাদা ভাষা − সস্যুর ফরাসি ভাষায় এর নাম দিয়েছিলেন ‘পারোল’ যাকে আমরা বাংলায় বলতে পারি ‘বাণী’। আমাদের প্রত্যেকের আলাদা একটি বাংলা ‘বাণী’ রয়েছে। পৃথিবীতে যদি ২০ কোটি বাঙালি থাকে তবে বাংলা ভাষা হবে এই ২০ কোটি বাংলা বাণীর সমষ্টি। একইভাবে বলা যেতে পারে যে পৃথিবীতে যদি ৬০০ কোটি মানুষ থাকে তবে ভাবমূর্তি বা দেবতাও আছে ৬০০ কোটি।
হিন্দু শাস্ত্রকারেরা মাত্র ৩৩ কোটি দেবতার কথা বলতেন এবং তাই শুনে দেবসমাজে পরিবার পরিকল্পনার অভাব নিয়ে রসিকেরা হাসাহাসি করে। হিন্দুধর্মে ঈশ্বর একজন কিন্তু দেবতা ৩৩ কোটি। ব্যাপারটাকে কি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না পৃথিবীর তখনকার লোকসংখ্যা ৩৩ কোটি বলে ভাবতেন তারা। উপনিষদের ঋষিরা ভাবতেন, বেদের শত শত দেবতা এক ঈশ্বরেরই ভিন্ন ভিন্ন রূপ। সেমিওটিকসের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা ভাবতে পারি, কোটি কোটি দেবতা বা ভাবমূর্তি মিলিত হয়ে সমাজমানসে সৃষ্টি হয় বিমূর্ত ঈশ্বরের ধারণা। এই ধারণাটিকে ‘দ্যোতিত’ বলা মুষ্কিল কারণ এটি একক কোনো মূর্তি নয়। সুতরাং ঈশ্বরের বহু দ্যোতক আছে বিভিন্ন ভাষায় ‘ঈশ্বর’, আল্লাহ, খোদা, God, Dieu কিন্তু একক কোনো দ্যোতিত সম্ভবত নেই।
একক ব্যক্তির পক্ষে যেমন সম্পুর্ণ বাংলা ভাষা জানা সম্ভব নয় তেমনি একক ব্যক্তির পক্ষে সম্পূর্ণ ঈশ্বরকে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। ব্যক্তি মানুষের মনে ঈশ্বরের যে মূর্তিটির সৃষ্টি হয় সেটি একটি দ্যোতিত, কিন্তু এটি ঈশ্বরের একমাত্র দ্যোতিত নয়। উনবিংশ শতকে ফ্রেগো নামে এক জার্মান দার্শনিক লিখেছিলেন, কোনো দু’টি মানুষই এক চাঁদ দেখে না, কারণ কোনো দু’টি মানুষের চোখের রেটিনার আকার এক নয়। চাঁদের সাথে ঈশ্বরের একটি পার্থক্য আছে: চাদের একটি নির্দেশিত আছে: আকাশে ঝুলতে থাকা চাঁদ। প্রত্যেকের মনে সৃষ্টি হওয়া চাঁদের দ্যোতিতকে এর নির্দেশিতের সাথে মিলিয়ে নেয়া যায়। কোনো দু’টি মানুষের মস্তিষ্কই এক নয়। সুতরাং আলাদা আলাদা মানুষের মস্তিষ্কে ঈশ্বরের আলাদা দ্যোতিত সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক।
আসল ঈশ্বর যদি থেকেই থাকেন তবে তিনি হবেন ‘অরূপ রতন’। যতই রূপসাগরে ডুব দিক মানুষ, এই অরূপ রতনের সন্ধান অন্তত মানুষের পাবার কথা নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সারাজীবনব্যাপী এই ‘জীবনদেবতা’র সন্ধান করেছেন। এত খুঁজে শেষ পর্যন্ত কি হলো শুনুন, রবীন্দ্রনাথের নিজেরই ভাষায় : ‘দিবসের শেষ সূর্য শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল, পশ্চিম সাগর তীরে নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়: কে তুমি? পেল না উত্তর।’ উত্তর আসার কথা নয়, কারণ ঈশ্বর যেহেতু মানুষ নন, সেহেতু প্রশ্ন বা উত্তর কোনোটারই ধার তিনি ধারেন না। আবার উত্তর পেলেও কোনো লাভ হত না রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করেছিলেন মানুষের ভাষা বাংলায়। কোনো উত্তর যদি এসেও থাকে তবে তা এসেছিল গায়েবী ভাষা বা দৈববাণীতে। এ ভাষা কবি বা নবী দু’জনের এক জনেরও বোধগম্য হওয়ার কথা নয়। যত ক্ষমতাই থাক না কেন এই দুই ব্যক্তির, এরা দু’জনেই মানুষ, এদের মস্তিষ্ক এবং ভাষা দুইই মানুষের।
ঈশ্বর: প্রয়োজনীয় একটি চিহ্ন
অনেক হুজুগে নাস্তিক (‘জ্ঞানী নাস্তিক’ যারা অর্থাৎ যারা জেনে শুনে নাস্তিক হয়েছেন তাদের কথা আলাদা) ঈশ্বর ও ধর্ম − এই দু’টি চিহ্নকে সমাজ থেকে চিরতরে বাদ দেওয়ার পক্ষপাতী। তাদের মতে: ঈশ্বর আর ধর্মের কারণে বহু যুদ্ধ, বহু দাঙ্গা, বহু রক্তপাত হয়েছে। এই ‘কুসংস্কার’ দু’টি মানুষে মানুষে বিভেদই সৃষ্টি করে শুধু। কিন্তু রক্তপাত তো বিজ্ঞানের কারণেও কম হয়নি। অ্যাটম বোমা থেকে শুরু করে ল্যান্ড মাইন পর্যন্ত এত বিচিত্র সব মারণাস্ত্র দাড়িওয়ালা মোল্লা বা টিকিধারী ব্রাহ্মণেরা তৈরি করেনি। শুধু ধর্ম নয়, বিজ্ঞানও মানুষের ধ্বংসের কারণ হয়েছে বহুবার। কিন্তু তাই বলে সমাজ ও জীবন থেকে বিজ্ঞানকে বাদ দেবার দাবি কেউ করেন না। বিজ্ঞান যেমন বোমা বানিয়েছে তেমনি কম্পিউটারও বানিয়েছে। ধর্ম বহুবার মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে মানবসভ্যতার গত পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে, কিন্তু মানুষের বহুবিধ উন্নতিও এই ধর্মের কারণেই হয়েছে। শুধুমাত্র বাইবেলের অনুবাদ করার প্রয়োজনে পৃথিবীর কত ভাষার প্রথম ব্যাকরণ লেখা হয়েছে, রচিত হয়েছে অভিধান। ধর্ম যদি না থাকত তবে মন্দির-মসজিদ-গীর্জা-প্যাগোডার মতো এত সুন্দর সব স্থাপত্য নিদর্শনই আমরা পেতাম কিভাবে? ধর্মের কারণে কত কত দর্শন, কাব্য রচিত হয়েছে। কোরান-বাইবেল-গীতা-ত্রিপিটককে ঈশ্বরের বাণী বলে স্বীকার করুন বা না করুন, এসব রচনার দার্শনিক ও সাহিত্যিক মূল্য অপরিসীম। ধর্মই যুদ্ধের একমাত্র কারণ নয়। বর্তমান শতকে ধর্মের কারণে অনেক দাঙ্গা হয়েছে এটা ঠিক, কিন্তু বড় বড় যুদ্ধগুলো, যেমন দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধের একটিও ধর্মের কারণে হয়নি। সুতরাং মানব সভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের মতো ধর্মেরও নেতিবাচক ও ইতিবাচক এই উভয় জাতীয় অবদান রয়েছে।
সমাজমানষের ক্রমবিবর্তনের ফলে ঈশ্বর ধারণাটি তৈরি হয়েছে মানুষেরই একটি বিশেষ মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনে। যদি মৃত্যু না থাকত, জীবনে পদে পদে বিপদ না থাকত, তবে ঈশ্বর ধারণার সৃষ্টি হত না মানুষের মনে। উন্নত দেশগুলোতে ঈশ্বরে অবিশ্বাসী লোকের সংখ্যা বেশি, কারণ সেখানে গড়পড়তা মানুষের জীবনে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা আছে। অনিশ্চিত জীবনে এমন কাউকে মানুষের দরকার যে তাকে নিরাপত্তা দেবে। জীবনের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সামাজিক শৃঙ্খলা একান্ত জরুরী। আমরা একে অন্যের ক্ষতি করব না। কেন করব না? করব না, কারণ তা পাপ। পাপ করলে অসুবিধা কি? অসুবিধা আছে। পৃথিবীতে শাস্তি পাবে তোমার পাপের জন্যে। জীবৎকালে শাস্তি যদি তুমি নাও পাও, তবে মৃত্যুর পরে পাপী তুমি সোজা যাবে নরকে আর পূণ্যবানেরা তোমাকে বাই বাই জানিয়ে ড্যাং ড্যাং করে রওয়ানা দেবে স্বর্গের পানে। সোজা হিসাব। ঈশ্বর ধারণার এই ফাংশনাল বা কেজো দিকটিকে উপেক্ষা করা চলে না। সমাজ চালাতে গেলে অনেক ফাংশনাল ধারণার প্রয়োজন হয়। ‘সত্য’ আর ‘ন্যায়বিচার’ এ রকম দু’টি ফাংশনাল ধারণা। সত্য বা ন্যায়বিচার বলে হয়তো আসলে কিছু নেই, কিন্তু সত্য বা ন্যায়বিচারকে বাদ দিয়েও সমাজ চালানো সম্ভব নয়।
ঈশ্বর ও ধর্মকে কোনোমতেই সমাজের সব ধরনের বৈষম্যের উৎস বলা যাবে না। ধনী-গরীবের যে বৈষম্য তা ধর্মের সৃষ্টি নয়। কমিউনিষ্ট রাষ্ট্রগুলোতে ধর্মকে নির্বাসন দিয়েও শ্রেণীবৈষম্য বিলুপ্ত করা যায়নি। সমাজে শ্রেণী সৃষ্টি হয়ে চলে, কারণ প্রতিটি মানুষের মস্তিষ্কের গঠন এক হলেও প্রতিটি মস্তিষ্কের প্রকৃতি আলাদা, পারিপার্শ্বিকতার সাথে তার মিথস্ক্রিয়াও এক নয়। সুতরাং প্রতিটি মানুষ অন্য একটি মানুষের চাইতে কিছুটা হলেও আলাদা। গভীরতর বিশ্লেষণে এই সত্যটিই উজ্জলতর হবে যে ধর্ম না থাকলেও সমাজে বৈষম্য বা বিভেদ সৃষ্টি হতে বাধা নেই। সৃষ্টির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য বৈচিত্র্য। লোকে যেমন বলে: হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না, তেমনি সমাজ যতদিন আছে ততদিন বৈষম্যও থাকবে। তবে আমাদের চেষ্টা থাকবে, এই বৈষম্য যাতে যথাসম্ভব কমিয়ে আনা যায়।
বিজ্ঞান, ধর্ম, ঈশ্বর… ইত্যাদি ধারণা ইতি-নেতি-নিরপেক্ষ অর্থাৎ এগুলো নেতিবাচকও নয়, ইতিবাচকও নয়। ব্যবহারের কারণেই এসব ধারণা ভালো বা খারাপ বলে মনে হয়। দোষ ঈশ্বরেরও নয়, বিজ্ঞানেরও নয়, দোষ মানবচরিত্রের। অসৎ লোকের হাতে পড়লে বিজ্ঞান ও ধর্ম উভয়েরই অপব্যবহার হয়ে থাকে। ধান্দাবাজ নেতারা ধর্ম আর ঈশ্বর ধারণার অপব্যবহার করে সমাজে অন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু সৎ ও চরিত্রবান নেতারা এ দু’টি ধারণার সঠিক ব্যবহার করে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করতে পারেন। বহুজনের হিত ও সুখ ধর্মের লক্ষ্য। প্রায় প্রত্যেক ধর্মই মানুষে মানুষে সমানাধিকারের কথা বলে এবং সাধারণত দরিদ্র্যের পক্ষে থাকে। খ্রিস্টধর্ম এমন কথাও বলা হয়েছে যে ‘সূচের ছিদ্র দিয়ে উট চলে গেলেও যেতে পারে কিন্তু ধনী ব্যক্তি স্বর্গে যেতে পারবে না।’ ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে ‘অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। এসব কথা মেনে চললে সমাজের ভালো ছাড়া খারাপ হবার কথা নয়। সুতরাং ‘ধর্ম’ ও ‘ঈশ্বর’− এ দু’টি ধারণাকে জোর করে বাদ না দিয়ে সমাজ-অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
বিজ্ঞান, ধর্ম ও ঈশ্বর এক একটি বৃক্ষের মতো। বৃক্ষে কাঁটাও আছে ফলও আছে। কাঁটা বাদ দিয়ে ফল পেড়ে খেতে জানতে হবে। কাঁটার যন্ত্রণার ভয়ে পুরো গাছটিকেই যদি কেটে ফেলা হয় তবে এর ফল থেকেও সমাজ বঞ্চিত হবে। যে কোনো ধর্ম হচ্ছে কাঁঠালের মতো। কাঁঠালের সবটা মানুষ খেতে পারে না। গরু সবটা খেতে পারে। যারা ধর্মকে অক্ষরে অক্ষরে মানতে চায় তাদের সঙ্গে গরুর মিল আছে। ধর্ম যদি মানব সমাজে কোনো সমস্যার কারণ হয়েই থাকে তবে তা যতটা না ধর্মের দোষে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের দুর্বুদ্ধির দোষে। কাঁঠালের কোষ না খেয়ে কেউ যদি আঠা খাওয়া শুরু করে তবে তা কাঁঠালের দোষ নয়। কাঁঠাল যেহেতু ‘জাতীয় ফল’ সেহেতু তার মধ্যে রস, আঠা, কাঁটা, বীচি, ভূতি সবই থাকবে, কারণ যে কোনো জাতি হচ্ছে বারো ভূতের আড্ডা এবং সব ভূতের প্রয়োজন সমান নয়। নির্বোধেরা কাঁঠালের আঠা বাঁচিয়ে চলতে পারে না। নির্বোধের যদি রবীন্দ্রনাথের মতো দাড়ি থাকে তবে তার পক্ষে কাঁঠাল খাওয়া আরও কঠিন। ‘তোমভি কাঁঠাল খায়া’ গল্পের কাবুলিওয়ালার মতো নির্বোধদের চুল-দাড়িতে ধর্মের আঠা জড়িয়ে যায়, রস পেটে ঢুকে না।
পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলোর প্রত্যেকটিরই বয়স হয়ে গেছে হাজার বছরের বেশি। হাজার বছর আগের মানুষ আর আজকের মানুষে পার্থক্য অনেক। হাজার বছর আগের সমাজের সাথে আজকের সমাজের মিল সামান্যই। ধর্মের নিয়মগুলো তৈরি হয়েছিল হাজার বছর আগের মানুষ আর সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে। হাজার হাজার বছর পরে এই সব নিয়মের উপযোগিতা সমান না হলেও প্রজন্মক্রমে মানতে মানতে ‘ধর্ম’ ও ‘ঈশ্বর’ ধারণা মানুষের বিশ্বাসের অন্তর্গত উপাদান হয়ে গেছে। এই দু’টি ধারণাকে কিছু লোক অন্তরে লালন করে কিন্তু অনেকেই প্রকাশ্যে জাহির করতে চায়। আপনারা গায়ে দিন বা না দিন, এ ব্যাপারে আমি আমার নিজের ব্যবহার করা একটি ‘ফতুয়া’ আপনাদের দিতে চাই: ‘বিশ্বাস হচ্ছে অর্ন্তবাসের মতো, সবাইকে দেখাতে নেই। যারা মনের বিশ্বাসকে প্রকাশ্যে জাহির করতে চায় তারা সুপারম্যানের মতো প্যান্টের উপর জাঙ্গিয়া পড়ে থাকে।’
হাজার বছরে মানুষ মেধায়-মননে বেড়েছে অনেক, কিন্তু জাঙ্গিয়া সেই একই রয়ে গেছে। কিছু কিছু দুর্বুদ্ধিজীবী ধর্মগ্রন্থের পরিবর্তন চান। পাগলামী! কালিদাসের মেঘদূত কি আবার নতুন করে লেখা যাবে? মেঘদূতে যদি কোনো ভুল থেকেই থাকে তবে সেই ভুলসহই মেঘদূতকে মেনে নিতে হবে। মেনে নেবো, সম্মান করব ধর্মগ্রন্থকে, কিন্তু এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও সচেতন থাকবো। সমাজ ও ব্যক্তির প্রয়োজন অনুসারে ধর্মের বহুবিধ ব্যাখ্যা সম্ভব এবং মানুষ তার প্রয়োজনমত তা করেও থাকে। প্রমাণ: হিন্দু শাস্ত্রের টীকা আর ইসলাম ধর্মের তাফসির। বিজ্ঞানের মতোই ধর্ম ও ঈশ্বর ধারণার পরিমিত ব্যবহার বাঞ্ছনীয়।
কেমন হতে পারে সেই পরিমিত ব্যবহার? মনে করুন, আপনার মায়ের পুরোনো কাপড়ের বাক্স খুজে আপনি আপনার ছোটবেলার একটি জামা খুঁজে পেলেন। যে কোনো কারণে বা প্রয়োজনে জামাটি পড়তে গেলে হয় জামাটি ছিঁড়ে যাবে অথবা আপনার শরীর কেটে যাবে। এমতাবস্থায় কি করা যায়? জামাটির তিন ধরনের ব্যবহারের কথা ভাবা যেতে পারে : ১. ড্রয়িংরুমের এক জায়গায় ঝুলিয়ে রাখলেন জামাটিকে (জামাটি আপনার অতীত। আপনার ছেলেমেয়ে-বন্ধুবান্ধবেরা আপনার ছেলেবেলার জামাটি দেখে চমৎকৃত হবে); ২. জামাটির সাথে নতুন কাপড় জোড়া দিয়ে বড়সড় করে নিয়ে জামাটি আবার ব্যবহার করা শুরু করলেন; ৩. নিজেকেই কেটেকুটে জামার মাপে ছোট করে নিলেন। তাতে আপনি নিজে মরলেও জামাটি তো বাঁচল!
পাশ্চাত্যে সুন্দর সুন্দর সব গীর্জা। বছর বছর এগুলো সংস্কার করা হয়। পাশ্চাত্যের মানুষ এসব ধর্মস্থানের ভিতরে খুব একটা ঢুকে না কিন্তু দূর থেকে নিজেদের সুন্দর অতীত দেখে আনন্দ পায়। মৌলবাদীরা হাজার বছর আগের ধর্মকে অক্ষরে অক্ষরে মানতে গিয়ে মানুষকে কেটে ছোট করতে চায়। এতে মানুষ মরে যায়। মানুষ মরে গেলে ধর্মও বাঁচে না। অথবা যা বাঁচে তা ধর্ম নয়, অধর্ম। ধর্মের মূল নিয়মগুলো এতই সার্বজনীন যে এগুলো যে কোনো যুগে যে কোনো মানুষের জীবনের সাথে কমবেশি মিলে যেতে পারে। বুদ্ধিমান মধ্যপন্থীরা ধর্মের কম গুরুত্বপূর্ণ ও যুগ-অনুপযোগী নিয়মগুলোকে সতর্কতার সাথে এড়িয়ে চলতে জানে, অর্থাৎ আঠা বাঁচিয়ে শুধু কাঠালের রসটুকু খেতে জানে তারা। এতে ধর্ম আর মানুষ উভয়েরই মঙ্গল।
ভলতেয়ারকে একবার নাকি জিগ্যেস করা হয়েছিল: মন্ত্র দিয়ে আদৌ ভেড়া মারা যায় কিনা। তিনি জবাব দিয়েছিলেন: ‘অবশ্যই যায় তবে তার আগে একটু সেঁকো বিষ খাইয়ে দিলে ভালো হয়।’ ধর্ম আর ঈশ্বর ছাড়া যে সমাজ চলে না তা নয় তবে এ দু’টি ধারণা থাকলে ভালো হয়। ঈশ্বর ও ধর্মের প্রধান সুবিধা হচ্ছে এই যে মানুষের মনে এই ধারণা দু’টি থাকার ফলে সে কমবেশি পাপ থেকে বিরত হয়। সব সমাজেই কিছু কিছু বকধার্মিক লোক ধর্ম ও ঈশ্বর উভয়কে কলা দেখায় − এটা ঠিক, কিন্তু সমাজের বেশির ভাগ মানুষই হরহামেশা পাপ করেন না, কারণ তাদের মধ্যে পাপ ও পূণ্যের এক ধরনের বোধ কাজ করে। সাধারণ মানুষের মনে এই বোধের উৎস ঈশ্বর ও ধর্ম। পাপের শাস্তি ও পুণ্যের পুরস্কার দেবার জন্য ঈশ্বরজাতীয় কেউ যদি না থাকেন, এবং কোনটা পাপ আর কোনটা পূণ্য তা নির্ধারণ করার জন্য যদি ধর্ম না থাকে তবে আমজনতার মনে পাপ-পূণ্যবোধের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যায়। কোনো একদিন নতুন কোনো ধারণা দিয়ে ঈশ্বর ও ধর্মকে প্রতিস্থাপিত করা গেলে এ দু’টি ধারণার গুরুত্ব হয়তো নিজে থেকেই কমে যাবে কিন্তু যতদিন তা না করা যাচ্ছে ততদিন এ ধারণা দু’টির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার বজায় রাখাই বাঞ্ছনীয়।
আজকের যুক্তিবাদী চিন্তাধারা সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপীয় নবজাগরণের কিছু আগে বা পরে। এর আগে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষকে সমাজবদ্ধ করা, মানুষের আদিম মনকে আজকের আধুনিকতার জন্য ধীরে ধীরে তৈরি করার ক্ষেত্রে ধর্ম ও ঈশ্বর প্রধান দু’টি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। ধর্ম ও ঈশ্বরের ভয়ে এখনও অন্তত কিছু মানুষ সৎ থাকে, সত্যবাদী হয়, পাপ করলে অনুতাপ করে। কিন্তু আগেই বলেছি, সব ভবী ভোলে না। সুতরাং যে কোনো সমাজে অন্যায়-অবিচার থাকে। যাবতীয় অবিচারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানোর জন্যে একজন ন্যায়পাল প্রয়োজন। ঈশ্বর সমাজমানসের সেই ন্যায়পাল।
উপরে উল্লেখিত টুকরো টুকরো এই সব ধারণা মিলিয়ে তৈরি হয়েছে মানুষের সমাজদর্শনের পাজল্ বা মোজাইক। রোমান স্থাপত্যে কোনো ইমারতের খিলান আর্চ বা গম্বুজের পুরো কাঠামোটি একটি মাত্র পাথরের অবস্থানের উপর নির্ভর করে। একে বলা হয় ‘কী-স্টোন’ বা ফরাসিতে ‘ক্লে দ্যা ভুউত’। এই পাথরটি খুলে নিলে পুরো খিলান বা গম্বুজটি ভেঙে পড়ে। ঈশ্বর সমাজ-গম্বুজের এই কী-স্টোন। কোনো একক ব্যক্তি ঈশ্বরে বিশ্বাস ছাড়া চলতে পারে। কিন্তু পুরো সমাজের পক্ষে সব সময় তা সম্ভব হয় না। কোনো না কোনো ফর্মে ঈশ্বর বাস করতে থাকেন সমাজ ও ব্যক্তিমানসে। আর ঈশ্বর যদি পুরোপুরি নির্বাসিত না হন তবে কায়ার সঙ্গে ছায়ার মতো, ধর্মও জড়িয়ে থাকে মানুষের মননে, সমাজ ও জীবনে।
নিজের আদলে ঈশ্বরকে কল্পনা করার কাজটি মানুষ প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে করে আসছে, আরও বহুকাল করবে। জানি না, ঈশ্বর ও ধর্মবিহীন সমাজ কোনোদিন গঠন করা সম্ভব হবে কিনা। আমি মনে করি, সম্ভব নয়। কোনো না কোনো ফর্মে এই দু’টি ধারণা ফিরে ফিরে আসবে। এতে আমি ক্ষতির কোনো কারণ দেখি না। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ঈশ্বর ধারণাকে বাতিল করার চেষ্টা হয়েছিল। সে চেষ্টা সফল হয়নি। সমাজতন্ত্রে অবশ্য এক ধরনের ভ-ামীও ছিল। ঈশ্বরকে নিষিদ্ধ করে সেখানে লেনিনের শবপূজা, মার্ক্স-মাওয়ের মূর্তিপূজা চালু করা হয়েছিল। আমি মনে করি, জোর করে বা আইন জারি করে কোনো ধারণাকে বাতিল করার চেষ্টা না করাই ভালো। সমাজমানসিক গঠনের স্বাভাবিক বিবর্তনের ফলে যদি কোনো ধারণা ধীরে ধীরে নিজে নিজেই অপসৃত হয় তবে সেটাই শ্রেয়তর।
ঈশ্বরকে নিয়ে এত সব কথা বলে ফেলার জন্য আমি ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইছি না, কারণ, প্রথমত, আমার এ লেখাটিতে ঈশ্বরকে মানুষের কল্পনার বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ‘হিউম্যান’ বা ‘মানুষালী’ গন্ধ থেকে মুক্ত হয়ে ঈশ্বর এখানে আরও বেশি ঐশ্বরিক হয়ে উঠেছেন। দ্বিতীয়ত, ঈশ্বর যদি থেকেই থাকেন তবে তার ইচ্ছা ছাড়া এ লেখাটি আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। তৃতীয়ত, ‘ক্ষমা চাওয়া’ একটি মানবিক গুণ। ক্ষমা আমি চাইতেই পারি যেহেতু আমি মানুষ। কিন্তু ঈশ্বরের ক্ষমা করা বা না করার প্রশ্নই ওঠে না কারণ, ঈশ্বর আর যাই হোন, আগেও বলেছি, আবারও বলছি, মানুষ তিনি নন।
প্রথম পর্ব: http://www.bdsfbd.com/archives/947
দ্বিতীয় পর্ব:http://www.bdsfbd.com/archives/950
তৃতীয় পর্ব: http://www.bdsfbd.com/archives/957
The post সেমিওলজি ও ঈশ্বর – শেষ পর্ব appeared first on Bangladesh Study Forum.